ভক্তিযোগের উদ্দেশ্য কি
শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ এই তিনটি হচ্ছে ভক্তিযোগের অঙ্গ। অতএব আমরা বলতে পারি স্বয়ং ভগবানের নাম মাহাত্ম কীর্তন শ্রবণ অথবা বিজ্ঞ আচার্যদের দিব্য জ্ঞান সম্মানিত দার্শনিক প্রবচন শোনার মাধ্যমে আমাদের মাঝে ভক্তিযোগ সাধিত হয়।
ভক্তিযোগের পথ প্রেম, নিষ্ঠা এবং সমর্পণের মাধ্যমে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অর্জনের পথ। এটি হিন্দু দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি যোগপন্থা, যেখানে ভক্তি বা আন্তরিক প্রেমের মাধ্যমে পরম সত্যকে উপলব্ধি করা হয়।
ভক্তিযোগের মূল উপাদানসমূহ
১. শ্রবণ (শোনার সাধনা) – ঈশ্বরের গুণগান, লীলা ও শাস্ত্র পাঠ শ্রবণ করা।
2. কীর্তন (গান গাওয়া) – ভক্তিগান ও স্তোত্রগান পরিবেশন করা।
3. স্মরণ (স্মরণ করা) – ঈশ্বরকে সর্বদা চেতনায় রাখা।
4. পাদসেবা (সেবাশ্রদ্ধা) – ঈশ্বরের মূর্তি বা ভক্তদের সেবা করা।
5. অর্চনা (পূজা করা) – মন্ত্রোচ্চারণ ও উপাসনার মাধ্যমে ঈশ্বরের উপাসনা করা।
6. বন্দন (নমস্কার বা প্রার্থনা করা) – ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও প্রার্থনা নিবেদন করা।
7. দাস্য (ভৃত্যভাব) – নিজেকে ঈশ্বরের সেবক হিসেবে গ্রহণ করা।
8. সাখ্য (সখাভাব) – ঈশ্বরকে প্রকৃত বন্ধু হিসেবে ভাবা।
9. আত্মনিবেদন (পরম আত্মসমর্পণ) – সম্পূর্ণভাবে ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করা।
শুধু ঘরে বসেই কি শিক্ষা লাভ করা যায় এবং তারপর ভগবানের সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করা যায়। যে-কোন অবস্থায় ভক্তিযোগ অত্যন্ত আনন্দদায়ক।
![]() |
ভক্তিযোগের উদ্দেশ্য |
পরম দারিদ্র্যের মধ্যেও ভক্তিযোগ সাধন করা যায়। ভগবান বলেছেন, পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ম্ তিনি ভক্তের নিবেদিত সব কিছুই গ্রহণ করতে প্রস্তুত এবং তা যা-ই হোক না কেন তাতে কিছু মনে করেন না। পত্র, পুষ্প, ফল, জল আদি পৃথিবীর সর্বত্রই পাওয়া যায় এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ ভগবানকে তা প্রেমভক্তি সহকারে নিবেদন করতে পারে। ভক্তি সহকারে ভগবানকে যা কিছু অর্পণ করা হয়, তা-ই তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে। ভগবানের চরণে অর্পিত তুলসীর সৌরভ শুধুমাত্র ঘ্রাণ করে সনৎকুমার আদি মহর্ষিরা মহাভাগবতে পরিণত হন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, ভক্তির পন্থা অতি উত্তম এবং অত্যন্ত সুখসাধ্য। ভগবানকে আমরা যা কিছুই নিবেদন করি না কেন, তিনি কেবল আমাদের ভালবাসাটাই গ্রহণ করেন।
এই ভক্তি মায়াবাদীদের মতবাদকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করে। মায়াবাদীরা কখনও কখনও নামমাত্র ভক্তি অনুশীলন করে এবং মুক্তি লাভ না করা পর্যন্ত তার আচরণ করতে থাকে, কিন্তু সব শেষে যখন তারা মুক্ত হয়, তখন ভক্তি ত্যাগ করে 'ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যায়'। অত্যন্ত স্বার্থপরায়ণ এই ভক্তিকে শুদ্ধ ভক্তি বলা যায় না। যথার্থ ভক্তিযোগের অনুশীলন এমন কি মুক্তির পরেও পূর্ববৎ চলতে থাকে। ভক্ত যখন ভগবৎ-ধামে ফিরে যান, তখন তিনি সেখানেও ভগবৎ-সেবায় মগ্ন থাকেন। 'ভক্ত কখনই ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন না।
ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, যথার্থ ভক্তিযোগের শুরু হয় মুক্তি লাভের পরে। মুক্তির পরে কেউ যখন ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তখনই তাঁর ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন শুরু হয় (সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মভক্তিং লভতে পরাম্)। স্বাধীনভাবে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, অষ্টাঙ্গযোগ অথবা অন্য যে কোন যোগ অনুষ্ঠান করলেও পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করা যায় না। এই সব যৌগিক পদ্ধতির সাহায্যে ভক্তিযোগের পথে মানুষ কিছুটা অগ্রসর হতে পারে, কিন্তু ভগবদ্ভক্তির স্তরে উপনীত না হলে পুরুষোত্তম ভগবান যে কি, কেউ তা বুঝতে পারে না। শ্রীমদ্ভাগবতে এই কথা প্রতিপন্ন করাও হয়েছে যে, ভক্তিযোগ সাধন করার ফলে, বিশেষত মহাভাগবতদের মুখারবিন্দ থেকে শ্রীমদ্ভাগবত অথবা ভগবদ্গীতা শ্রবণ করলে কৃষ্ণতত্ত্ব বা ভগবৎ-তত্ত্ব জানা যায়। এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ। হৃদয় যখন সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্তি ও অনর্থ থেকে মুক্ত হয়, তখন মানুষ বুঝতে পারে ভগবান কি। এভাবেই ভগবদ্ভক্তি বা কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থা হচ্ছে সমস্ত বিদ্যার রাজা এবং সমস্ত গুহ্যতত্ত্বের রাজা। এটি হচ্ছে পরম বিশুদ্ধ ধর্ম এবং আনন্দের সঙ্গে অনায়াসে এর অনুশীলন করা চলে। তাই, এই পন্থা গ্রহণ করা মানুষের অবশ্যই কর্তব্য।
ভক্তিযোগের উদ্দেশ্য কি?
ভক্তিযোগের লক্ষ্য হল, ঈশ্বরের প্রতি গভীর প্রেম ও নিষ্ঠার মাধ্যমে মোক্ষ (মুক্তি) লাভ করা। এই পথে আত্মসংযমের পাশাপাশি ঈশ্বরের প্রতি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস ও ভালোবাসা রাখতে হয়। এটি সাধারণত সরল ও হৃদয়গ্রাহী পন্থা, যা কোনো কঠোর তপস্যার পরিবর্তে প্রেমময় ভক্তিকে গুরুত্ব দেয়।
ভক্তিযোগ হল যোগের এক বিশেষ শাখা, যেখানে ভক্তি বা আন্তরিক ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা হয়। এটি প্রধানত শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ভাগবত পুরাণ এবং অন্যান্য বৈদিক গ্রন্থে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ভক্তিযোগের মূল ধারণা: ভক্তিযোগে প্রধানত ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ভক্তিকে কেন্দ্র করে সাধনা করা হয়। এটি গুণ, কর্ম বা জ্ঞানভিত্তিক যোগের চেয়ে সহজ ও হৃদয়গ্রাহী বলে মনে করা হয়। ভক্তির মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করাই এর মূল লক্ষ্য।
ভক্তিযোগের স্তরসমূহ:
১. শ্রবণ (শোনা) – ঈশ্বর সম্পর্কিত কাহিনি, উপদেশ ও শাস্ত্র পাঠ করা।
2. কীর্তন (গান করা) – ঈশ্বরের গুণ ও মহিমা কীর্তন করা।
3. স্মরণ (স্মরণ করা) – ঈশ্বরের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন চিন্তা করা।
4. পাদসেবন (সেবা করা) – ঈশ্বরের চরণে সেবা নিবেদন করা।
5. অর্চনা (পূজা করা) – প্রতিদিন ভগবানের পূজা-অর্চনা করা।
6. বন্দন (নমস্কার করা) – ভক্তিভরে ঈশ্বরকে প্রণাম করা।
7. দাস্য (সেবক হয়ে থাকা) – ঈশ্বরকে নিজ প্রভু ও নিজেকে তাঁর সেবক রূপে ভাবা।
8. সখ্য (বন্ধুত্ব অনুভব করা) – ঈশ্বরকে বন্ধু হিসেবে ভাবা।
9. আত্মনিবেদন (সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা) – নিজের সমস্ত কিছু ঈশ্বরকে অর্পণ করা। ভক্তিযোগের গুরুত্ব: মানসিক শান্তি ও আত্মিক উন্নতি লাভ হয়। অহংকার দূর হয় এবং বিনয় ও প্রেম বৃদ্ধি পায়। ঈশ্বরের কৃপা লাভ হয়, যা মোক্ষ বা মুক্তির পথকে সহজ করে। এটি যে-কেউ গ্রহণ করতে পারে, জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদের বাধা নেই।
উপসংহার: ভক্তিযোগ কেবল একটি আধ্যাত্মিক পথই নয়, বরং এটি এক গভীর প্রেমের অভিব্যক্তি। এই যোগের মাধ্যমে ভক্ত ও ঈশ্বরের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে। যারা হৃদয় দিয়ে ঈশ্বরকে অনুভব করতে চান, তাদের জন্য ভক্তিযোগ সর্বোত্তম পথ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন