ভক্তিযোগের পথ অত্যন্ত সুখসাধ্য

ভক্তিযোগের অঙ্গ হচ্ছে শ্রবণং কীর্তনং বিষ্ণোঃ, সুতরাং ভগবানের নাম মাহাত্ম্য শ্রবণ, কীর্তন অথবা প্রামাণিক আচার্যদের দিব্যজ্ঞান সমন্বিত দার্শনিক প্রবচন শোনার মাধ্যমে ভক্তিযোগ সাধিত হয়। শুধু বসে বসেই শিক্ষা লাভ করা যায় এবং তারপর ভগবানের সুস্বাদু প্রসাদ আস্বাদন করা যায়। যে-কোন অবস্থায় ভক্তিযোগ অত্যন্ত আনন্দদায়ক। 

ভক্তিযোগের পথ অত্যন্ত সুখসাধ্য কেন?

পরম দারিদ্র্যের মধ্যেও ভক্তিযোগ সাধন করা যায়। ভগবান বলেছেন, পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ম্ তিনি ভক্তের নিবেদিত সব কিছুই গ্রহণ করতে প্রস্তুত এবং তা যা-ই হোক না কেন তাতে কিছু মনে করেন না। পত্র, পুষ্প, ফল, জল আদি পৃথিবীর সর্বত্রই পাওয়া যায় এবং জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ ভগবানকে তা প্রেমভক্তি সহকারে নিবেদন করতে পারে। ভক্তি সহকারে ভগবানকে যা কিছু অর্পণ করা হয়, তা-ই তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেন। ইতিহাসে এর অনেক উদাহরণ আছে। ভগবানের চরণে অর্পিত তুলসীর সৌরভ শুধুমাত্র ঘ্রাণ করে সনৎকুমার আদি মহর্ষিরা মহাভাগবতে পরিণত হন। এভাবেই আমরা দেখতে পাই যে, ভক্তির পন্থা অতি উত্তম এবং অত্যন্ত সুখসাধ্য। ভগবানকে আমরা যা কিছুই নিবেদন করি না কেন, তিনি কেবল আমাদের ভালবাসাটাই গ্রহণ করেন।


এই ভক্তি মায়াবাদীদের মতবাদকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করে। মায়াবাদীরা কখনও কখনও নামমাত্র ভক্তি অনুশীলন করে এবং মুক্তি লাভ না করা পর্যন্ত তার আচরণ করতে থাকে, কিন্তু সব শেষে যখন তারা মুক্ত হয়, তখন ভক্তি ত্যাগ করে 'ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যায়'। অত্যন্ত স্বার্থপরায়ণ এই ভক্তিকে শুদ্ধ ভক্তি বলা যায় না। যথার্থ ভক্তিযোগের অনুশীলন এমন কি মুক্তির পরেও পূর্ববৎ চলতে থাকে। ভক্ত যখন ভগবৎ-ধামে ফিরে যান, তখন তিনি সেখানেও ভগবৎ-সেবায় মগ্ন থাকেন। 'ভক্ত কখনই ভগবানের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন না।


ভগবদ্গীতায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, যথার্থ ভক্তিযোগের শুরু হয় মুক্তি লাভের পরে। মুক্তির পরে কেউ যখন ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তখনই তাঁর ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন শুরু হয় (সমঃ সর্বেষু ভূতেষু মভক্তিং লভতে পরাম্)। স্বাধীনভাবে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, অষ্টাঙ্গযোগ অথবা অন্য যে কোন যোগ অনুষ্ঠান করলেও পরম পুরুষোত্তম ভগবানকে উপলব্ধি করা যায় না। এই সব যৌগিক পদ্ধতির সাহায্যে ভক্তিযোগের পথে মানুষ কিছুটা অগ্রসর হতে পারে, কিন্তু ভগবদ্ভক্তির স্তরে উপনীত না হলে পুরুষোত্তম ভগবান যে কি, কেউ তা বুঝতে পারে না। শ্রীমদ্ভাগবতে এই কথা প্রতিপন্ন করাও হয়েছে যে, ভক্তিযোগ সাধন করার ফলে, বিশেষত মহাভাগবতদের মুখারবিন্দ থেকে শ্রীমদ্ভাগবত অথবা ভগবদ্গীতা শ্রবণ করলে কৃষ্ণতত্ত্ব বা ভগবৎ-তত্ত্ব জানা যায়। এবং প্রসন্নমনসো ভগবদ্ভক্তিযোগতঃ। হৃদয় যখন সম্পূর্ণভাবে ভ্রান্তি ও অনর্থ থেকে মুক্ত হয়, তখন মানুষ বুঝতে পারে ভগবান কি। এভাবেই ভগবদ্ভক্তি বা কৃষ্ণভাবনামৃতের পন্থা হচ্ছে সমস্ত বিদ্যার রাজা এবং সমস্ত গুহ্যতত্ত্বের রাজা। এটি হচ্ছে পরম বিশুদ্ধ ধর্ম এবং আনন্দের সঙ্গে অনায়াসে এর অনুশীলন করা চলে। তাই, এই পন্থা গ্রহণ করা মানুষের অবশ্যই কর্তব্য।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url