বেদ ও গীতা এবং মহাভারত সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তর

হিন্দুরা কেন বেদের চাইতে গীতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়? গীতা কিসের বই? এর লেখক কে? শুনেছি এটা নাকি মহাভারতের একটা অংশ?

সনাতন ধর্মের অনুসারীরাঅন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।বেদ এর স্থান সনাতন ধর্মে সবার উপরে। বেদের চারটি অংশের মধ্যে একটি হলো উপনিষদ।আর গীতা পড়লে দেখতে পাবেন এর প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে একে উপনিষদ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । বৈদিক সাহিত্য একটি গ্রন্থাগার স্বরূপ ।ফলে ছাত্র ছাত্রীরা যে কারনে মূল পাঠ্যবই এর থেকে নোটবই বেশি পছন্দ করে,সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সেই একই কারণে গীতা কে গুরুত্ব দেন।

বেদ গীতা মহাভারত
বেদ গীতা মহাভারত 


গীতা সনাতন ধর্মে ঈশ্বর লাভের যে চারটি পথ - জ্ঞান,যোগ,কর্ম ও ভক্তি তার সমন্বয় সাধন করছে ও স্মরণাগতি বা আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিয়েছে ।


গীতার বক্তা ঈশ্বর,শ্রোতা পৃথিবীর সকল মুমুক্ষু মানুষের প্রতিনিধি অর্জুন আর লেখক কৃষ্ণ দৈপায়ণ ব্যাস।


ভগবত গীতা মহাভারতের ভীষ্ম পর্বের(২৪ থেকে ৪২ অধ্যায়) অন্তর্গত। পন্ডিতগণমনে করেন যে অষ্টমশতাব্দীতে শ্রীশঙ্করাচার্য প্রথম এইঅধ্যায়গুলিকে মহাভারত থেকে আলাদা করেন এবং গীতা হিসাবে এর একটি ভাষ্য লেখেন।


এতক্ষণ আপনার প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলাম। এবার সনাতন ধর্মে গীতার স্থান সম্পর্কে কিছু বলে এই প্রসঙ্গে ইতি টানব।


প্রস্থানত্রয় বা প্রস্থানত্রয়ী বলতে হিন্দু দর্শনের প্রধানত তিনটি প্রধান ধর্মগ্রন্থকে বোঝায়। এগুলি হল:


১ উপনিষদ্ বা শ্রুতি-প্রস্থান


২ ভগবদ্গীতা বা সাধন-প্রস্থান বা স্মৃতি-প্রস্থান


৩ ব্রহ্মসুত্র বা ন্যায়-প্রস্থান বা যুক্তি-প্রস্থান


এখানে প্রস্থান অর্থ সংসার ত্যাগ (জন্ম -মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তি বা মোক্ষ লাভ)।সেই প্রস্থানের জন্য উপনিষদ হলো প্রমাণ (authentic scriptures) ,ভগবদ্গীতা হলো পথনির্দেশিকা (guide line )এবং ব্রহ্মসুত্র হলো এর পিছনে যুক্তি ( rationale support)।


একটা কথা বলব যেটা সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য সেটা হলোঃ ধর্ম মূলত একটি আরোহ বিধি ( পন্থা ) বুঝতে পারলেন না | সমস্যা নেই বলছি , এই পদ্ধতির মাধ্যমে সৃষ্টিতত্ত্ব তথা ঈশ্বর তত্ত্ব


স্বীকার করে নেয়া হয় | আর এই তত্ত্বগুলো বর্ণিত থাকে বিভিন্ন ধর্মের গ্রন্থগুলোতে |


এখন বিষয় হলো সনাতন ধর্মের ক্ষেত্রে কেন বেদের চাইতে গীতাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় ?


এর আগে বলে রাখি বেদের অপর নাম অপৌরষেয় অর্থাত এটা কোনো পুরুষ দ্বারা সৃষ্টি বা রচিত হয় নি ( এখানে পুরুষ বলতে প্রচলিত ধারণার স্ত্রী-পুরুষ বুঝায় নি মূলত সৃষ্টিকর্তাকে বলা হয়েছে ) |

গীতা এটা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত বাণী | গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে জ্ঞানযোগ অধ্যায়ে গীতার (এই লেখাটি লেখার কারন ,অন্য উত্তরগুলি , হিন্দু ধর্মের যে সু বিশাল গৌরবময় ইতিহাস আছে তাকে সম্পূর্ণ রূপে অগ্রাহ্য করে হয়েছে ।হিন্দু ধর্ম পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্ম এবং ইহার বাহ্যিক রূপ ক্রমশঃ বিবর্তিত হয়েছে তা কে অস্বীকার করা যায় না ।আমি আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান অনুসারে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব )


বেদের ধর্ম হলো বৈদিক ধর্ম ।ইহা কত বছর আগে চালু ছিল তা নিয়ে প্রচুর মতভেদ আছে ।এক সময় এই বৈদিক ধর্মের পরিসমাপ্তি ঘটে । গড়ে ওঠে বেদ অনুসারী ধর্ম । আজকে যে হিন্দু ধর্ম কে জানেন তা অস্তিক্য দর্শন ( যে দর্শন বেদ অনুসারী ) অনুযায়ী চলে ।অস্তিক্য দর্শন  মূলত 6 টি যা ষড় দর্শন নামে খ্যাত এগুলি হল সাংখ্য, যোগ, বেদ ও গীতার মধ্যে কোনটি সর্বাধিক প্রাচীন? গীতা কখন রচিত হয় আর বেদ কখন রচিত হয়?

গীতা প্রথম কে লিখেছেন?

হিন্দুরা কেন বেদ না পড়ে গীতা পড়ে?


'হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থের নাম কি', প্রশ্ন করলে উত্তর হয়, 'বেদ'।


শুদ্র, নারী এবং উপনয়ন না হওয়া বালকের বেদে অধিকার ছিল না। আগ্রহ নিশ্চয়ই ছিল; কিন্তু সাধারণের ভাষায় তার অনুবাদ হতো না।


সাধারণ মানুষ, সাধারণের ভাষায় রচিত দেব-দেবীর পাঁচালীতেই ধর্মাচরণ এবং প্রার্থনার পথ পেতো।


মহাভারত সর্বসাধারণের জন্য লেখা হলেও, সর্বসাধারণের সাধ্য ছিল না, সেই গ্রন্থ পাঠে। (মধুসূদন দত্তের কথায়, " চন্দ্রচূড় জটাজালে আছিলা যেমতি জাহ্নবী, ভারতরস ঋষি দ্বৈপায়ণ ঢালি সংস্কৃত হ্রদে রাখিলা তেমতি। তৃষ্ণায় আকুল বঙ্গ করিতো রোদন …"


মহাভারত সাধারণের ভাষায় অনূদিত হল, গীতার ও অনুবাদ হল।


গীতার জ্ঞানে, সাধারণ মানুষের ধর্মাচরণ বড় সহজ এর মূল কারণ হল অজ্ঞতা। বেদ একমাত্র আমাদের প্রধান ধর্ম গ্রন্থ। ভাগবত গীতা মহাভারতের একটি ছোট অংশ মাত্র। এরকম অনেক গীতাই মহাভারত থেকে এসেছে।


বেদের সহজলভ্য নয় এবং এরজন্য গুরু পরম্পরা এবং বিশেষ অধিকার লাগে যা হিন্দুদের অনেকেই জানেন না আর এঁদের এই ব্যাপারটাও নেই। অন্যদিকে ভাগবত গীতার জনপ্রিয়তা খুব বেশী দিনের না। মধ্যযুগে আদি শংকরের পূর্বে অনেকেই এর নামও শুনে নাই। পরে আরও বৈষ্ণব কিছু ভন্ড গুরুদের কারনে ভারতে বৈদিক গ্রন্থের পাশাপাশি এই ভাগবত গীতা সামনে আসে। এবং এইসব ভন্ড গুরুদের কারণে পরবর্তীতে একে বেদের সার বলে অনেকটা ফাউ উড়ো খবর মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া হয়। মূলত এই গীতা অনেকেই শ্রীকৃষ্ণ কথিত মনে করেন 'গীতা' একটা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা দার্শনিক তত্ত্ব ও দৃষ্টি ভঙ্গির সংকলন। এর লেখক কে আজ কেউ খুঁজে পাবেনা।


কে বা কাহারা এই লেখনটির ওপর একটা ধর্মের জামা পরিয়ে, কোন এক ব্যাক্তি বিশেষকে গৌরবান্বিত করতে এটা মহাভারতে প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।


আর সেই থেকে এটাকে কোন এক বিশেষ ধর্মের সারাংশ হিসেবে মানা বা নীতিবাক্যের প্রবচন হিসেবে ব্যাবহার হয়ে আসছে।

গীতা কি মহাভারতের খন্ডাংশ বা সারাংশ, নাকি আলাদা কোনো গ্রন্থ?


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের ৬ষ্ঠ পর্ব তথা ভীষ্ম পর্বের অধ্যায় ২৫ হতে অধ্যায় ৪২ পর্যন্ত মোট ১৮ টি অধ্যায়ের সমষ্টি। সেই হিসেবে এটি মহাভারতেরই অভিন্ন অংশ।


কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে অর্জুন তার আত্মীয়-পরিজনকে দেখে মোহগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং তিনি যুদ্ধ করতে চান না বলে জানান। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাকে আত্মার স্বরূপ , ব্রহ্ম সম্পর্কিত জ্ঞান , কর্ম , ধর্ম , ভক্তি , গুণ বিভাগ , মনুষ্য প্রকৃতি ও তার মুক্তির উপায় সমন্ধে নানা উপদেশ দিয়ে অর্জুনকে আপন কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে দেন। অতঃপর তিনি যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হন।


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা এর ১৮ টি অধ্যায় হল -


১) বিষাদ যোগ


২) সাংখ্য যোগ


৩) কর্ম যোগ


৪)জ্ঞান যোগ


৫)কর্ম


মহাভারত এবং গীতা বই দুটো কি আলাদা?


আমাকে প্রশ্ন টি করার জন্য ধন্যবাদ। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও শ্রীশ্রী চন্ডী এই দুটি হিন্দুদের সবথেকে বেশি পঠিত গ্রন্থ। এদের উভয়কেই সপ্তশতী বলে।অধিকাংশ মানুষের ধারণা এই দুটি স্বতন্ত্র বই,কিন্তু তা নয়!


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাঃ


মহাভারতের ৬ষ্ঠ পর্ব তথা ভীষ্ম পর্বের অধ্যায় ২৫ হতে অধ্যায় ৪২ পর্যন্ত মোট ১৮ টি অধ্যায়ের সমষ্টি। সেই হিসেবে এটি মহাভারতেরই অভিন্ন অংশ। গীতার শ্লোক সংখ্যা -:ধৃতরাষ্ট ১টি,সঞ্জয় ৪০টি,অর্জুন ৮৫টি,শ্রীকৃষ্ণ ৫৭৪মোট. ৭০০ টি ।


শ্রী শ্রী চন্ডীঃ


চন্ডী ও কোন স্বতন্ত্র গ্রন্থ নয়। এটি মার্কন্ডেয় পুরাণের অংশ বিশেষ। মার্কন্ডেয় মহা পুরাণের ৮১তম - ৯৩তম এই ত্রয়োদশ অধ্যায়ে শ্রী শ্রী চন্ডীর মাহাত্ম্য বর্ণিত সনাতন ধর্মের অনুসারী ও অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল1 বছর


সম্পর্কিত


মহাভারতে শ্রীমদ্ভগবদগীতা কি প্রক্ষিপ্ত?


শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা মহাভারতের ৬ষ্ঠ পর্ব তথা ভীষ্ম পর্বের অধ্যায় ২৫ হতে অধ্যায় ৪২ পর্যন্ত মোট ১৮ টি অধ্যায়ের সমষ্টি। সেই হিসেবে এটি মহাভারতেরই অভিন্ন অংশ। এখন কথা হল শ্রীমদ্ভগবদগীতা প্রক্ষিপ্ত কিনা। এর উত্তর হ্যাঁ এবং না। সাহিত্য হিসেবে গীতা অংশটি ও মহর্ষি কৃষ্ণ দৈপায়ন ব্যাসদেব এর রচিত। কিন্তু গীতার যে শিক্ষা অর্থাৎ নিস্কাম কর্ম ও আত্ম সমর্পণ -সেটা চিরায়ত। শ্রী কৃষ্ণ নিজেই গীতায় বলেছেন -


চতুর্থ অধ্যায় (জ্ঞান যোগ)


ভগবান উবাচ

ইমম বিবস্বতে যোগম্‌ প্রোক্তবান অহম্‌ অব্যয়ম্‌ ।

বিবস্বান মনবে প্রাহ মনুঃ ইক্ষাকবে অব্রবীত্ ।।১

অর্থ-ভগবান বললেন-অমি পুর্বে সুর্য্যদেব বিবশ্বানকে এই অব্যয় নিস্কাম কর্মসাধ্য গীতা কি দৈব? নাকি, মহাভারত রামায়ণের মতো কোনও ব্যক্তির রচিত?


এটির আসল উত্তর ছিল: গীতা কী দৈব? নাকি মহাভারত, রামায়ণের মত কোন ব্যক্তির রচিত?


কোন গ্রন্থ ঈশ্বর প্রেরিত কিনা তা জানার প্রধান উপায় হলো যুক্তি ও বানীর মৌলিকত্ব ৷ যেমন বিজ্ঞান জগতে মৌলিক আবিষ্কার হয় , তেমন হিন্দু দর্শন জগতে নতুন দর্শন আবিষ্কার হয় ৷ গীতার বানী পড়লেই আপনি বুঝবেন এতে নতুন জীবন দর্শন , এবং বানীর শক্তির প্রকাশ ৷ প্রতিটি বানী পড়লেই বুঝবেন সেটা সাধারন মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয় ৷


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url