মহাভারতের খল চরিত্র সত্যবতী ও বিদুর চরিত্র
চণ্ডী, মনসা এদের দেখুন কীভাবে নিরীহ মানুষকে দিনের পর দিন অমানুষিক অত্যাচার করে নিজেদের পুজো আদায় করেছেন। রামায়ণেও খল চরিত্রের অভাব নেই। তবে মহাভারতকে খল চরিত্রের আকর বললেও হয়তো ভুল বলা হবে না।
সত্যবতী ও বিদুর ছবি |
আপাত দৃষ্টিতে হয়তো মনে হতে পারে যে ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন, শকুনি, কর্ণ এরাই বোধ হয় মহাভারতের খল চরিত্র। কিন্তু না। ভাল মানুষের মুখোশ পরা অনেক খল চরিত্রের সন্ধান এই মহাকাব্যে পাওয়া যাবে। আমার তো মনে হয় মূলত একটি পরিবারই মহাভারতের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য দায়ি। আরও মজার কথা এই পরিবারের কারোরই শরীরে কিন্তু কৌরব রক্ত নেই।প্রথমেই আসা যাক রানী সত্যবতীর প্রসঙ্গে। মহাভারতের অনেক নারী পুরুষের মতোই সত্যবতীর জন্ম কাহিনিও রহস্যময়। চেদিরাজ বসুর ঔরসে ও এক মৎস রূপিনী অপ্সরার গর্ভে তাঁর জন্ম। কথিত আছে ধীবর রাজা দাশ অপ্সরার গর্ভে সত্যবতীকে তার যমজ ভাইয়ের সঙ্গে দেখতে পান। তাদের চেদিরাজের কাছে নিয়ে গেলে চেদিরাজ ছেলেটিকে নিজের কাছে রেখে মেয়েটির (সত্যবতীর) প্রতিপালনের দায়িত্ব দাশ রাজার হাতে অর্পণ করেন। এই সত্যবতী কুমারী অবস্থায় পরাশর মুনির সঙ্গে মিলিত হলে ব্যাসদেবের জন্ম হয়।
সত্যবতীকে দেখে কৌরব বংশের রাজা শান্তনু তাকে বিবাহ করতে চাইলে দাশ রাজা একটি শর্ত দেন যে সত্যবতীর সন্তানকেই রাজা করতে হবে। সত্যবতী-শান্তনুর জ্যেষ্ঠ পুত্র চিত্রাঙ্গদ বিয়ে করার আগেই মারা যান। বিচিত্রবীর্য তখন নিতান্তই বালক। তবে দেশে তো একজন রাজা চাই। তাই বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসিয়ে রানী সত্যবতীই বকলমে রাজ্য শাসন করতে থাকেন। এই বিচিত্রবীর্যের খুব অল্প বয়সেই বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায়। আর এই ব্যবস্থা করেন ভীষ্ম। যেহেতু বিচিত্রবীর্যের পক্ষে স্বয়ংবর সভায় গিয়ে অম্বিকা ও অম্বালিকার বরমাল্য নেওয়া সম্ভব ছিল না (অম্বার কাহিনি এখানে আর বলছি না) তাই স্বয়ং ভীষ্ম ওই দুই নারীকে স্বযংবর সভা থেকে তুলে নিয়ে এসে বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।এর অল্প কিছুদিন পর অপুত্রক অবস্থায় বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু হলে আবার দেশ রাজাহীন হয়ে গেল। তখন সত্যবতী তাঁর নিজস্ব খেলায় মেতে উঠলেন। তিনি ভীষ্মকে প্রথমে অনুরোধ করেন অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান উৎপাদন করার জন্য।
তিনি জানতেন যে ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করবেন না। তাই ভীষ্ম রাজি না হলে তিনি তাঁর কানীন পুত্র ব্যাসদেবকে ডেকে পাঠালেন। ব্যাসদেব সঙ্গে সঙ্গে হাজির ও এক কথায় রাজি। অনেকে বলেন যে মহাভারতের যুগে তো নিয়োগ প্রথা ছিল তাই সত্যবতী কোন অন্যায় করেননি। কিন্তু নিয়োগ প্রথায় স্বামীর অনুমতির প্রয়োজন হত। আর শাশুড়ির নির্দেশে বিধবা দুই পুত্র বধূর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করা আইন সংগতও নয়, ন্যায় সংগতও নয়। কিন্তু সত্যবতীর তখন আইন বা ন্যায় বিচার করার কোন দরকার নেই।
যেন তেন প্রকারে তার মনস্কামনা পূর্ণ করতে হবে। তাই এই অন্যায় কাজের জন্য ওই দুই সদ্য বিধবা নারীদের সম্মতি নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করলেন না তিনি। সরাসরি তার পুত্রের শয্যা সঙ্গিনী হবার আদেশ দিলেন তাদের।ব্যাসদেব ওই দুই নারীকে ধর্ষণ করলেন। হ্যাঁ, ধর্ষণ করলেন। কোন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সম্ভোগ করা ধর্ষণ বই আর কিছু নয়। ওই দুই নারী যে স্বেচ্ছায় ব্যাসদেবের অঙ্কশায়িনী হননি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ অম্বিকা ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন ও অম্বালিকা ভয়ে পাণ্ডুর হয়ে গিয়েছিলেন। আর এই অনৈতিক সম্ভোগের ফলে জন্ম হল ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর।
প্রকৃতপক্ষে এঁদের কেউই কিন্তু কৌরব নন। এঁদের কারো শরীরেই কিন্তু কৌরব রক্ত নেই। আর একটা বিষয় আমার বোধগম্য হয় না তা হল ধৃতরাষ্ট্র না হয় জন্মান্ধ তাই তার রাজা হবার সম্ভাবনা নেই কিন্তু পাণ্ডু তো আছে। তাহলে অম্বিকাকে আবার ব্যাসদেবের অঙ্কশায়িনী করতে পাঠানোর কী প্রয়োজন ছিল?জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূকে ধর্ষিতা হতে আবার পাঠাবার কোন প্রয়োজন ছিল কি দ্বিতীয় বার? ছিল বৈকি। সে কথায় পরে আসছি।ব্যাসদেব কিন্তু একটা ব্যাপারে সত্যনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বা তাঁর সন্তানদের কৌরব বলে বর্ণনা করলেও পাণ্ডুপুত্রদের (?) কিন্তু কখনোই কৌরব হিসাবে বর্ণনা করেননি। ব্যাসদেবের মতে যুদ্ধ হয়েছিল কৌরব আর পাণ্ডবদের মধ্যে। কিন্তু সকলেই যদি কুরুরাজের বংশধরই হয়ে থাকে তবে এই যুদ্ধকে কৌরবদের দুই পক্ষের যুদ্ধ হিসাবেই বর্ণনা করাই স্বাভাবিক ছিল।এরপর আসব মহাভারতের আর এক খল চরিত্র বিদুর প্রসঙ্গে। যার জন্মই ছলনার মধ্য দিয়ে সে ব্যক্তি যে কপটাচারী হবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! দ্বিতীয় বার যখন সত্যবতী অম্বিকাকে ব্যাসদেবের অঙ্কশায়িনী করতে পাঠালেন তখন অম্বিকা তাঁর শূদ্রা দাসীকে পাঠিয়ে দিলেন ব্যাসদেবের কাছে।
সেই দাসী এক ব্রাহ্মণের অঙ্কশায়িনী হওয়ার আনন্দে মশগুল। আর অন্যদিকে ব্যাসদেব অম্বিকা মনে করে ওই নারীকে সম্ভোগ করলেন। ফলে জন্ম নিলেন বিদুর। এবার চিন্তা করুন ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতা কৌরব বংশীয় না হলেও তাঁদের মাতা কিন্তু কৌরব কুলবধূ। কিন্তু বিদুরের না বাবা না মা কেউই কৌরব বংশের কেউ নন।মহাভারতে কথিত আছে সেকালে অর্ণীমাণ্ডব্য নামে এক ঋষি ছিলেন। তাঁর অভিশাপেই ধর্ম শূদ্রা যোনিতে জন্ম নেন। আর তিনিই বিদুর। অর্থাৎ বিদুর হলেন শাপভ্রষ্ট ধর্ম। তিনি তো দাসীপুত্র তাই তিনি রাজা হতে পারেন না। অথচ তিনিই কিন্তু সত্যবতীর আপন মানুষ। তিনিই সত্যবতীর পৌত্র। প্রকৃতপক্ষে ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু সত্যবতীর পৌত্র হলেও কুরু বংশের ছোঁয়া কিন্তু তাদের আছে। কারণ তাঁদের মায়েরা কৌরব কুলবধূ। কিন্তু সত্যবতীর পুত্রের প্রকৃত বংশধর হলেন বিদুর।
তাই সত্যবতী এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে বিদুরই রাজ্য চালাতে পারেন। কারণ বিচিত্রবীর্যের বকলমে তিনিই রাজ্য চালিয়েছিলেন আবার পাণ্ডুর স্বেচ্ছা বনবাসের পর অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে সিংহাসনে বসিয়ে তিনিই রাজ্য চালিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যবতীর তো বয়স হয়েছে। তিনি আর ক’দিন। তিনি বিদুরকে মহামাত্য করে দিলেন যাতে হস্তিনাপুর তাঁর বংশের কব্জাতেই থাকে।পাণ্ডুর বনবাসের সঙ্গে সঙ্গে বিদুরও ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে ঝগড়া করে পাণ্ডুর সঙ্গে বনবাস করতে চলে গেলেন। তারপর আবার হস্তিনাপুরে ফিরেও এলেন। এরপর আর পাণ্ডু ও তাঁর দুই স্ত্রীর কোন খবর নেই। দ্বাদশ বর্ষ পরে কুন্তী পঞ্চ পাঁচটি বালককে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলেন হস্তিনাপুরে। দৈববাণীর মাধ্যমে জানা গেল যে এরাই পঞ্চ পাণ্ডব। কিন্তু পাণ্ডুর তো সন্তান উৎপাদনের কোন ক্ষমতা ছিল না। তবে? তার ব্যাখ্যাও পাওয়া গেল। জানা গেল যে বড় পুত্র যুধিষ্ঠির আসলে ধর্মপুত্র। কিন্তু ধর্ম তো তখন অর্ণীমাণ্ডব্যর অভিশাপে মনুষ্য জীবন যাপন করছেন। আর সে তিনি তো এখন বিদুর।
তবে কি …..? হ্যাঁ, এর উত্তর খুঁজে পেতে তো আর কোন অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।এবার বিদুরের চাতুরি ও ক্রুরতার দুই একটা নিদর্শন পেশ করব। দুর্যোধনের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে পরামর্শ দেন যে জন্ম মুহূর্তেই দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করতে হবে নইলে সমূহ বিপদ। একটি শিশু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে এ ধরণের পরামর্শ দেবার কারণ কী? আসলে তিনি জানতেন যে ধৃতরাষ্ট্রই যখন রাজা (যদিও জন্মান্ধ হওয়ায় তিনি প্রকৃত রাজা হতে পারেননি) তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রই হবেন রাজ সিংহাসনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। তাঁর পুত্র যুধিষ্ঠিরের সিংহাসনে বসার কোন আশা নেই। পাশা খেলার ওই দৃশ্যটা স্মরণ করুন বিদুর দুর্যোধনকে পাশা খেলা থেকে নিবৃত্ত করতে চাইলেও একবারের জন্যও যুধিষ্ঠিরকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলেন না। কারণ তিনি জানতেন যুধিষ্ঠির কখনই পিতৃ আজ্ঞা লঙ্ঘন করবেন না। বিদুরের ক্রুরতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন জতুগৃহ হত্যা। তিনি যখন জানতেনই যে কুন্তী আর পাঁচ ভাইকে পুড়িয়ে মারা হবে তখন তাঁদের জতুগৃহ থেকে বেরিয়ে যাবার পরামর্শ তিনি দিতেই পারেন কিন্তু কী প্রয়োজন ছিল এক নিরীহ মাতা ও তার পাঁচটি ছেলেকে খুঁজে নিয়ে এসে ওই জতুগৃহে রাত্রিবাস করানোর? মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের অন্য চার ভাই বিদুরকে ‘তাত’ বলে সম্বোধন করলেও যুধিষ্ঠির কিন্তু বিদুরকে কনিষ্ঠ পিতা বলেই সম্বোধন করতেন।ভাবতে অবাক লাগে কি অসাধারণ কৌশলে সত্যবতী ও বিদুর ব্যাসদেবের বংশধরদের হাতে হস্তিনাপুরের রাজত্ব তুলে দিয়েছিলেন।
NB:স্বপন ভট্টাচার্য লেখনী থেকে নেয়া।