রুদ্রাক্ষ শোধন পদ্ধতি ও রুদ্রাক্ষ ধারণের উপকারিতা
রুদ্রাক্ষ হলো একপ্রকার বৃহৎ ও চওড়া পাতাওয়ালা চিরহরিৎ বৃক্ষ যার বীজ হিন্দুধর্মাবলম্বীগণ বিভিন্ন ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করেন। এই গাছ Elaeocarpus গণভুক্ত; এর অনেক প্রজাতি রয়েছে যার মধ্যে E.হিন্দু তথা সনাতন ধর্মীয় 'মালা' তৈরির কাজে লাগে এই ganitrus প্রজাতিটি।
রুদ্রাক্ষ শোধন :- জারাই রুদ্রাক্ষ কিনেছেন, শোধন না করিয়ে এনেছেন তারা শোধন করে রুদ্রাক্ষ ধারন করবেন তানাহলে রুদ্রাক্ষ কাজ করবে না। নিয়ম: উপকরন:-দুধ,দই,ঘি,মধু,চ—িনি, শুদ্ধজল বা গঙ্গাজল,বেলপাতা,১০৮ বা ৮ বা ২৮ টি ফুল,মালা,নৈবেদ্ য,ধূপ,দ্বীপ,কর্পূর,শ্বেত চন্দন। নিয়ম:- শুদ্ধাসনে পূর্বদিকে মুখ করে বসুন। দ্বীপ ধূপ জ্বালান। পাথরের বাটিতে বা মাটির পাত্রে বা কাঁসার পাত্রে রুদ্রাক্ষটি রাখুন। আচমন:- তিনবার ডান হাতে সামান্য জল নিয়ে নিন্মোলিখিত মন্ত্র পাঠ করতে করতে তিনবার জল পান করুন।শেষে হাতটি ধুয়ে ফেলুন। মন্ত্ৰ: আত্মতত্ত্বায় স্বাহা। ওঁ বিদ্যাতত্ত্বায় স্বাহা। ওঁ শিবতত্ত্বায় স্বাহা। জলশুদ্ধি:-শাং মন্ত্রে যে জলে পূজা করছেন তার উপর ডানহাতের মধ্যমা দিয়ে একটি দিয়ে একটি ত্রিভূজ আঁকুন। আসনশুদ্ধি:- শাং মন্ত্রে আপনার আসনের তলায় একটা অনুরুপ ত্রিভূজ আঁকুন। ডান হাতের মধ্যমা দিয়ে। পুষ্পশুদ্ধি:- শাং মন্ত্রে ফুলের উপর গঙ্গাজল ও চন্দনের ছিটা দিয়ে পূষ্পশুদ্ধি করুন। মন্ত্র পাঠ করুন:- ওঁ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবৰ্দ্ধনং উর্বারুকমিব বদ্ধনান্মত্যো মুক্ষীয়মামৃতাৎ।। এর পর নিন্মলিখিত মন্ত্রে রুদ্রাক্ষকে স্পর্শ করে প্রান প্রতিষ্ঠা করুন:- ওঁ হোঁ অঘোরে ওঁ হোঁ ঘোরে ওঁ হুং ঘোরতরে ওঁ হৈ জীং শ্ৰী ঐ সর্বেতঃ সর্বেভ্যো নমহস্ত্ত রুদ্ররুপিপে হুঁ হুঁ নমঃ এর পর ৮/২৮/১০৮ টি বেল পাতা চন্দন দিয়ে বেলপাতার অগ্রভাগটা অল্প একটু ছিঁড়ে অর্ধেক প্রদক্ষিন করে নিন্মলিখিত মন্ত্র উচ্চারন করে রুদ্রাক্ষকে শিব রুপে পূজা করবেন।
বেলপাতা প্রদানের মন্ত্র:- ওঁ পূর্ন বৃক্ষ মহাভাগং সদাত্বং মহেশ প্রিয় মহেশং পূজা নিমিত্তং বরদা ভব শোভনে ১০ বার শিবগায়ত্রী মন্ত্র উচ্চারন করুন:- তৎপুরুষায় বিঘ্নহে বেদমহীমহাদেবায় ধীয়োমহো তন্নো রুদ্র প্রচোদয়াৎ।। ১০৮ বার হাত জড়ো করে, চোখ বন্ধ করে- ওঁ নমঃ শিবায় মন্ত্র উচ্চারন করুন। এরপর ক্ষমা চেয়ে বিসর্জন। বিসর্জন মন্ত্র:- আবহনং নজনামি নৈবজনামি নৈবজনামি পূজনং বিসর্জনং ন জনামি ক্ষমধ্য পরমেশ্বর।।
রুদ্রাক্ষ শোধন মন্ত্র |
বিভিন্ন মুখী রুদ্রাক্ষ ও রুদ্রাক্ষ ধারণে মেলে নানাবিধ ফলঃ
‘বিবেক চিন্তামণি’’ নামক মহা গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, জগতের উদ্ধারের জন্য ভগবান শিবের নেত্র থেকে রুদ্রাক্ষের উৎপত্তি হয়েছে, যার মহিমা বর্ণনা করা খুবই কঠিন। যদিও সকল প্রকার রুদ্রাক্ষের জন্ম ভগবান শিবের মাধ্যমেই হয় তবুও রুদ্রাক্ষের প্রকারভেদে ধারকের ফলপ্রাপ্তি কিন্তু বিভিন্ন হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রকৃতি ভেদে রুদ্রাক্ষের স্বরূপও বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে।
রুদ্রাক্ষের স্বরূপ ও ফলাফল গুলি দেখে নেওয়া যাক -
১। একমুখী রুদ্রাক্ষ( শিবের স্বরূপ) - এই রুদ্রাক্ষ ধারণে ব্রহ্ম হত্যার মত পাপও বিনাশ হয় ও তার থেকে মুক্তি লাভ করাও সম্ভব হয়।
২। দ্বিমুখী রুদ্রাক্ষ (হরগৌরীর স্বরূপ) - এই রুদ্রাক্ষ ধারণে হরগৌরী সদাই সন্তুষ্ট থাকেন, আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং সাধনায় সিদ্ধি লাভ করা যায় ও গো-হত্যা জনিত পাপ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
৩। তিন-মুখী রুদ্রাক্ষ (অগ্নিদেবতার স্বরূপ) - এই রুদ্রাক্ষ ধারণে স্ত্রী হত্যা জনিত পাপ থেকে মুক্তি মেলে।
৪। সাক্ষাত ব্রহ্ম স্বরূপ(চারমুখী রুদ্রাক্ষ)- এই রুদ্রাক্ষ ধারণে শ্রী-বৃদ্ধির সঙ্গে ও জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটে এবং সকল প্রকার রোগের থেকে আরোগ্য লাভ হয় । সেই সঙ্গে চিত্ত প্রসন্ন থাকে ও নর হত্যার পাপ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়।
৫। পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ (কালাগ্নি রুদ্র স্বরূপ ) - ধারণে অখাদ্য বস্তুর আহারে হওয়া পাপের বিনাশ ঘটে।
৬। ছয়-মুখী রুদ্রাক্ষ (সাক্ষাত কার্তিকের স্বরূপ) - ধারণে গণহত্যার পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং ‘কার্তিকের’ ব্রত পালনে ধর্ম-কর্মে মতি আসে।
৭। সাতমুখী রুদ্রাক্ষ (অনন্ত স্বরূপ) - ধারণে সর্ব প্রকার পাপ থেকে মুক্ত হয়ে দারিদ্র দূরীকরণ ঘটে থাকে।
৮। আট-মুখী রুদ্রাক্ষ(গণেশের স্বরূপ) - ধারণে সর্বপ্রকার দোষ খণ্ডন এবং সকল বাধা বিঘ্ন দূর হয়ে গিয়ে পরম পদের প্রাপ্তি ঘটে থাকে।
৯। নয়-মুখী রুদ্রাক্ষ (দুর্গা স্বরূপ) - ধারণে সকল প্রকার দুঃখ কষ্টের বিনাশের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরের ওপরে ভক্তি বৃদ্ধি এবং মুক্তি লাভ সম্ভব হয়।
১০। দশ-মুখী রুদ্রাক্ষ (বিষ্ণু স্বরূপ) - এই রুদ্রাক্ষ ধারণের ফলে ভূত, প্রেত, ব্রহ্মদৈত্য, পিশাচ ইত্যাদির ভয় দূর হয়।
১১। এগারো-মুখী রুদ্রাক্ষ (রুদ্র, ইন্দ্র স্বরূপ) - স্ত্রীদের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীর সুরক্ষা, উন্নতি, সৌভাগ্য তথা দীর্ঘায়ু দানে এই রুদ্রাক্ষ ধারণ করা উচিত। সন্তান সুখের ক্ষেত্রেও এই শ্রেণীর রুদ্রাক্ষ উপকারী।
১২। বারো-মুখী রুদ্রাক্ষ( সূর্য স্বরূপ) - ধারণে চেহারায় তেজস্বী ভাব আসে। হীনবল হয়ে পড়লেও এই রুদ্রাক্ষ ধারণে সুফল মেলে। মান, প্রতিষ্ঠা, দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেতেও এই রুদ্রাক্ষ সাহায্য করে। রূপ, লাবণ্য বৃদ্ধিতে এবং ধারককে সদা প্রসন্ন রাখতে এই শ্রেণীর রুদ্রাক্ষ খুবই সিদ্ধ হয়।
১৩। তেরো-মুখী রুদ্রাক্ষ (কামদেবের স্বরূপ) - ধারণে মনের বাসনা পূর্ণ হয় এবং কোনও প্রকারের অকল্যাণ হয় না।
১৪। চৌদ্দমুখী রুদ্রাক্ষ (শিব, হনুমান স্বরূপ) - জীবনে সুখ সমৃদ্ধির বৃদ্ধি ঘটে থাকে। সর্বপ্রকার সম্মান প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সকল সুখ-শান্তি এবং আয়ু বৃদ্ধি ঘটে থাকে। এই প্রকার রুদ্রাক্ষ ধারণকারী ব্যক্তি শিব-রূপী হয়ে থাকেন। এই রুদ্রাক্ষ সর্বরোগে বিনাশের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকে নীরোগ রাখতে সাহায্য করে।
পরিশেষ -রুদ্রাক্ষ ধারণ এক অতি পবিত্র বিষয় বলে পরিগণিত হয় সনাতন ধর্মে/হিন্দু ধর্মে । রুদ্রাক্ষকে শৈবাগম মনে করে মহাদেবের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ। নেপালে জন্মানো রুদ্রাক্ষকেই গুণগত মানে উন্নত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিবিধ কারণে সনাতন জ্যোতিষে রুদ্রাক্ষ ধারণের নির্দেশ রয়েছে। প্রাচীন তামিল শৈব সিদ্ধান্ত-গ্রন্থ ‘তিরুমন্তিরম’ বিশদে জানায় রুদ্রাক্ষ-মহিমা। ওম্ নমঃ শিবায়।।