ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার সঠিক তথ্য কোনটি
প্রথমে আমরা জেনে নেই সাকার কি -সাকার কথাটি হিন্দীতে ব্যাপক ভাবে ব্যবহৃত হয় ।
সাকার কি সাকার = স (উপসর্গ) + আকার = সাকার অর্থাৎ আকারের সহিত । বাংলায় আমারা সস্ত্রীক (স্ত্রীর সহিত ) ও সপুত্র (পুত্রের সহিত) কথাগুলির সঙ্গে পরিচিত।এখন আকার মানে একটি shape .একটা আকার আছে প্রত্যেকটি বস্তুর । সাকার মানে give a shape . সাকার প্লান হিন্দিতে কোন পরিকল্পনা কে বলা হয় , চিত্রের outline এবং idea ( চিন্তাধারা ) কে shape দেবার জন্য ব্যবহৃত হয় । এখন shape দেওয়া মানে কি ? Shape দেওয়া মানে হল বাস্তবায়িত করা।
বাংলায় পরিকল্পনাকে আমরা বাস্তবায়িত করি আর হিন্দীতে পরিকল্পনাকে সাকার করি ।সাকার' = স + আকার অর্থাৎ আকার সহ বা আকার সমেত।না,সাকার আর আকার কথা দুটির অর্থ ভিন্ন।'আকার' একটি নাম পদ। যেমন - রসগোল্লার আকার গোল।অন্য দিকে 'সাকার' হলো বিশেষণ পদ। এর অর্থ হলো "যার আকার আছে " অর্থাৎ আকারযুক্ত।সাকারের বিপরীত শব্দ 'নিরাকার' অর্থাৎ যার আকার নেই।তাই সাকার আর আকার শব্দ দুটি সম্পর্কযুক্ত ,কিন্তু ভিন্ন অর্থ বিশিষ্ট।
ঈশ্বর সাকার নাকি নিরাকার ছবি |
ব্রহ্মের রূপের বর্ণনা করেছে উপনিষদ যদিও সরাসরি ব্রহ্মের প্রতিমা বা মূর্তি নাই।
‘এই পুরুষের রূপ হরিদ্রারঞ্জিত বসনের মতো পীতবর্ণ, মেঘলোমের মতো পাণ্ডুবর্ণ, ইন্দ্রগোপ কীটের মতো রক্তবর্ণ; অগ্নিশিখার মতো, শ্বেত-পদ্মের মতো এবং চমকিত বিদ্যুতের মতো’। বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ২/৪/৬
স্বয়ং বেদ বলেছে- অমূর্ত ব্রহ্ম প্রাপ্তি দুর্জ্ঞেয় ও তপস্যাদি বহু প্রয়াসের পরও ব্রহ্মদর্শন ব্রহ্মেরই কৃপাসাপেক্ষ। কঠ উপনিষদ, ১/২/২৩
ব্রহ্মসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের দ্বিতীয় পাদে আছে, ‘‘অরূপবদেব হি, তৎপ্রধানত্বাৎ’’ অর্থাৎ ব্রহ্ম নিশ্চিতভাবেই নিরাকার, কারণ তিনি বেদ ও বেদান্তের প্রধান প্রতিপাদ্য (বর্ণনীয়) বিষয়। পরে বলা হয়েছে- ‘‘তদব্যক্তমু আহ হি’’ অর্থাৎ শাস্ত্রে ব্রহ্মকে অব্যক্ত বা ইন্দ্রিয়াতীতও বলে উপদেশ দিয়েছেন। ‘কেন’ উপনিষদে আছে, ‘‘সেই ব্রহ্মে চক্ষু গমন করে না তর্থাৎ চক্ষু দ্বারা তাঁকে দেখা যায় না, বাক্য দ্বারা তাকে প্রকাশ করা যায় না এবং মন দ্বারাও তাকে মনন বা চিন্তা করা যায় না’’। সোজা কথায় ব্রহ্ম চক্ষু, কর্ণ আদি ইন্দ্রিয় ও মনের অগোচর অর্থাৎ ব্রহ্ম নিরাকার। ঈশ উপনিষদে আছে- ‘‘যিনি ব্রহ্ম হতে তৃণ পর্যন্ত সমস্ত ভূত বা বস্তুকে আত্মাতেই দর্শন করেন এবং সমস্ত ভূত বা বস্তুর মধ্যে নিজের আত্মাকেই দর্শন করেন, তিনি এ রকম দর্শনের পর কাউকে ঘৃণা করেন না’’। অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বভূতে বিরাজমান। একমাত্র নিরাকার বস্তুই সর্বভূতে বিরাজিত থাকতে পারে।
ঈশ্বর স্বরূপত নির্গুণ একথাটি বেদান্ত মতে , নিরাকার এবং অব্যক্ত হলে ঈশ্বরের সাকার রূপের কল্পনা কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে ব্রহ্মসূত্রে বলা হয়েছে, ‘‘বৃদ্ধ্যর্থঃ পাদবৎ’’ অর্থাৎ উৎপাসনার সুবিধার্থে ব্রহ্মের পাদ আদি রূপ কল্পনা করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘‘ব্রহ্ম চার পাদ ও ষোড়শ-কলা বিশিষ্ট। প্রকাশবান, অনন্তবান, জ্যোতিষ্মান ও আয়তনবান এই হল ব্রহ্মের চার পাদ। প্রতি পাদে চার কলা রয়েছে। প্রকাশবানে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণ দিক নামক কলা, অনন্তবানে পৃথিবী, অন্তরীক্ষ, দ্যুলোক ও সমুদ্র নামক কলা, জ্যোতিষ্মানে অগ্নি, সূর্য, চন্দ্র ও বিদ্যুৎ নামক কলা এবং আয়তনবানে প্রাণ চক্ষু, কর্ণ ও মন নামক কলা রয়েছে। ব্রহ্মের এই সাকার রূপ কাল্পনিক ও রূপক কারণ কোন বস্তুর রূপ ঐ রকম থাকতে পারে না। মূলত ব্রহ্মকে সহজ উপায়ে চিন্তা করার জন্য তাঁর রূপের কল্পনা করা হয়েছে। ব্রহ্মসূত্রে আছে- ‘‘স্থানবিশেষাৎ, প্রকাশাদিবৎ’’ অর্থাৎ স্থান বিশেষের জন্য ব্রহ্মের সাকার রূপ কল্পনা করা হয়ে থাকে; যেমন- আকাশ, আলোক প্রভৃতির ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। একটি ঘটের মধ্যস্থ আকাশ আর বাইরের আকাশের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, শুধু নাম বা উপাধির পার্থক্য থাকে। তদ্রূপ ঘরের ভেতরের আলো ও বাইরের আলো একই, শুধু পৃথক নাম ও উপাধি দেয়া হয় মাত্র। যখন ঘটের বিনাশ হয় তখন ঘটের ভিতরের ও বাইরের আকাশ এক হয়ে যায়, তেমনি ঘরের বিনাশ হলে ঘরের ভেতরের ও বাইরের আলো এক হয়ে যায়। শুধু নাম বা উপাধির জন্যই নিরাকার ব্রহ্মকে সাকার বলে মনে হয়।
অদ্বৈত বেদান্তবাদীদের মতে ঈশ্বর ও জীবে কোন ভেদ নেই অর্থাৎ জীবই ঈশ্বর কিন্তু মায়ার কারণে মনে হয় ঈশ্বর জীব থেকে পৃথক। ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে- সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম অর্থাৎ সব কিছুই ব্রহ্ম। কঠ উপনিষদে আছে, ‘‘মনসৈবেদমাপ্তব্যং নেহ নানাসিত্ম কিঞ্চন। মৃত্যোঃ স মৃত্যুং গচ্ছতি য ইহ নানেব পশ্যতি।।’’ অর্থাৎ এই জগতে ব্রহ্ম হতে পৃথক কিছুই নেই, এই তত্ত্বটি সংস্কৃত মন দ্বারাই উপলব্ধি করতে হবে। যে ব্যক্তি এই জগৎকে ব্রহ্ম হতে পৃথক মনে করে, সে মৃত্যু হতে মুক্তি পায় না। মানুষ এভাবে প্রতিটি বস্ত্তকে ঈশ্বরজ্ঞান করলে তাঁর হিংসা দূরীভূত হয়ে যেত কারণ যাকে হিংসা করবে সেও তো ঈশ্বর। সুতরাং একথাই বলা চলে যে, ব্রহ্ম অজ্ঞেয়, অচিন্ত্য এবং অসীম। তাই সীমাবদ্ধ চক্ষু, কর্ণ, প্রভৃতি ইন্দ্রিয় দ্বারা তাঁকে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। ঈশ্বরের সাকার রূপ আসলে কি? মূলত পাত্রভেদে ঈশ্বর সাকার বা নিরাকার। মানুষ তার জ্ঞান-বুদ্ধি অনুসারে ঈশ্বরের বিভিন্ন আকার-আকৃতি চিন্তা করে। যে ভক্ত বুদ্ধি বা জ্ঞান-বিচার করে উপলব্ধি করেন যে, ঈশ্বর সাকার এবং সাধনাবলে তাঁকে দর্শন করা সম্ভব, সে ভক্তের মনে ঈশ্বরের একটি কাল্পনিক চিত্র অঙ্কিত হয়। ইন্দ্রিয়গণের অধিপতি মন এবং মনের অধিপতি বুদ্ধি বা জ্ঞান। ভক্তের জ্ঞান-বুদ্ধি বলে ঈশ্বর সাকার। যেহেতু বুদ্ধি মনের অধিপতি সেহেতু বুদ্ধির নির্দেশে ভক্তের মনে ঈশ্বরের একটি চিত্র অঙ্কিত হয়। ঈশ্বরের সে চিত্রকে প্রত্যক্ষ করার জন্য তাঁর মন পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয়কে (চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, ও ত্বক) নির্দেশ দেন। তখন ভক্ত সাধনাবলে যে মায়াকে বশীভূত করতে পেরেছেন, সে মায়া তাঁর পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয়ের উপর ক্রিয়া করে। পরিশেষে ভক্ত মনের কল্পিত ঈশ্বররের মায়াময় রূপ চক্ষুর সম্মুখে দর্শন করেন। মায়া দ্বারা বশীভূত ঐ চক্ষুই দিব্য-চক্ষু নামে খ্যাত। সুতরাং ঈশ্বর স্বরূপত নিরাকার এবং তাঁর সাকার রূপ মূলত মায়াময়। মায়া যেহেতু অস্থায়ী, সেহেতু ঈশ্বরের সাকার রূপও অস্থায়ী।সেইজন্য জ্ঞানযোগীরা ঈশ্বরকে বড় জোর কোন জ্যোতি বা আলোকরশ্মি রূপে কল্পনা করেন কিন্তু কখনই সাকার মূর্তির কল্পনা করেন না। জ্ঞানযোগীরা বলেন, ঈশ্বরের যদি দেহ থাকে তবে তাঁর ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি ও চৈতন্য থাকবে। যদি ঈশ্বরের মন থাকে তবে তাঁর ইচ্ছা, চিন্তা, সুখ, দুঃখ, রাগ, দ্বেষ প্রভৃতি থাকবে কারণ এগুলো মনের বৃত্তি। কিন্তু ঈশ্বর তো সুখ-দুঃখ, রাগ-দ্বেষ প্রভৃতির ঊর্ধে, কেননা ঐ সব গুণ থাকলে ঈশ্বর পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়বেন। আবার দেহ ও মন যেহেতু নশ্বর, সেহেতু ঈশ্বরও নশ্বর হবেন। সুতরাং যেহেতু ঈশ্বর অবিনশ্বর সেহেতু তিনি সাকার নন।ব্রহ্ম বা ঈশ্বর অব্যক্ত বলেই দুর্লভ। ঈশ্বর যদি সুলভ বস্তু হতেন, তবে তিনি সকলের পরম আরাধ্য হতেন না।
(বিঃ দ্রঃ- এটি আমার মৌলিক লেখা নয়, যেহেতু কয়েকজন অনুরোধ করেছেন তাই বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা থেকে সাহায্য নিয়েছি।)
ধন্যবাদ এডমিন সঠিক তথ্য গুলো দেবার জন্য।।