গুরু ত্যাগ করা যায় কি
হরেকৃষ্ণ গত পোষ্টে আলোচনা করেছিলাম, সদগুরুর কি কি যোগ্যতা দরকার. গুরু গ্রহনের পূর্বে কি করা দরকার. কোন পরম্পরা থেকে দীক্ষা গ্রহন করা উচিত যারা এই পোস্ট টি মিস করেছেন, তারা আমার টাইমলাইন থেকে পড়ে নিবেন। আজকের আলোচনা সদশিষ্য ও গুরুত্যাগ বিষয়ে.! আমাদের সমাজে একদল মানুষ আছে, যারা পারমার্থিক গুরু গ্রহনে আগ্রহি। সেখানে সেখানে গুরু খুজে বেড়ায়। কেউ কেউ গুরুদেবের যোগ্যতা দেখেন, কেউ গুরুর অলৌকিক কিছু আছে কিনা তা দেখেন। কেউ আবার দেখেন এই গুরুদেব টাকা পয়সার ধান্ধা করে কিনা, তা যাচাই করেন।এমন হাজার জনের হাজার রকম চিন্তা। আবার একদল লোক আসে তার প্রতিবেশি এক গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছে এখন সন্মানের দায়ে তার ও একটু দীক্ষার নিয়ে নামটা ফুটাতে হবে। গুরু যা হয় হোক। কেউ বা আবার লোক দেখানো দীক্ষা গ্রহন করেন। পাড়ার লোক অমুক গুরুদেবের থেকে দীক্ষা নিচ্ছে তার শিষ্য সংখ্যা বেশি, তো আমার ও তার কাছ থেকে দীক্ষা নিতে হবে। নয়তো পাড়ার লোকদের সাথে আবার ভাবের অমিল হবে তাই। কিন্তু গুরুদেব কেমন হওয়া উচিত বা কি কি যোগ্যতা দরকার তা কেউ বিবেচনা করে না।
গুরুত্যাগ করা যায় কি |
সদ্গুরু কখনাে ত্যাগ করা যায় না। তা করা গুরুতর অপরাধ । কিন্তু গুরু অসৎ ও অযােগ্য হলে, ভগবান এবং ভগবৎপ্রদত্ত শাস্ত্রবিধি ঠিকমতাে মেনে না চলেন, তবে তাকে ত্যাগ করাই বিধেয়। ঠিক যেভাবে বলি মহারাজ তার কুলগুরু শুক্রাচার্যের আদেশ অমান্য করে ভগবান বামনদেবের চরণে আত্মসমর্পণকরেছিলেন। প্রহাদ মহারাজ তার পিতার আদেশ অমান্য করে শ্রীবিষ্ণুর শরণ নিয়েছিলেন। বিভীষণ তার বড় ভাই রাবণকে ত্যাগ করে শ্রীরামচন্দ্রের শরণ নিয়েছিলেন। ভরত তার মাতা কৈকেয়ীকে ত্যাগ করেছিলেন। সুতরাং, গুরু বলুন, পিতা বলুন, ভ্রাতা বলুন অথবা মাতা, যদি তারা যথার্থ ভূমিকা পালন না করেন, ভগবদ্বিদ্বেষী হন, তবে তাদের ত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয় এবং নিজের ও জগতের জন্য তা মঙ্গলজনক । আর দীক্ষা এবং যথাতথা গুরুদেব নিয়ে সংশয়ের কোন কারন নেই। একজন সদগুরুদেবের যোগ্যতা কি, তা নিয়ে আমার একটি পোস্ট লেখা আছে। আমার টাইম লাইনে দেয়া আছে দেখে নিবেন (যারা না পরেছেন সেটি)। যাহোক সদগুরুর যোগ্যতা তো জানলাম।
শাস্ত্রে এটা নির্দেশ দেওয়া আছে যে গুরুনিন্দা বা গুরু ত্যাগ করা যায় না। অর্থাৎ কেউ যদি অবৈষ্ণবের কাছ থেকে দীক্ষা নেয় তাকে নরকে গমন করতে হয়। হরিভক্তিবিলাসে (৪/১৪৪) বলা হয়েছে "কেউ যদি ভুলক্রমে অবৈষ্ণবের কাছ থেকে মন্ত্র দীক্ষা নিয়ে থাকে, তবে তার পক্ষে অবশ্যই বৈষ্ণব গুরুর নিকট মন্ত্র দীক্ষা গ্রহন করা উচিত" যাকে গুরু রুপে গ্রহন করা হয়েছে সে যদি কৃষ্ণ ভক্ত না হয়, হরে কৃষ্ণ মন্ত্র দীক্ষা না দিয়ে থাকে, আমিষ আহার, নেশা, দ্যুতক্রীড়া, অবৈধ সঙ্গ করে বৈধ সম্প্রদায়ভুক্ত না থাকে তবে তাকে পরিত্যাগ করতেই পরিস্কার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শাস্ত্র বিধি অনুসারে সেরূপ গুরু পরিত্যাগ কোনো দোষ হয় না, বরং মঙ্গল লাভের জন্য পুনরায় পারমার্থিক গুরুর আশ্রয় গ্রহন কর্তব্য। ব্ৰহ্মবৈবত্ত পুরানে ব্রহ্মখন্ডে (৮/৯৫/৯৬) বলা হয়েছে "গুরু, পিতা বা স্বামী যদি শ্রী হরির প্রতি ভক্তি শিক্ষা না দেয়, তবে তাদের সম্মান করা বিরম্বনা মাত্র।
উত্তর হল, না। একটা ভাল স্কুলে পরতে হলে যেমন মেধাবী স্টুডেন্ট দের ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেতে হয়( তাতে সে যত মেধাবী হোক বা যত ক্ষমতাশালী ব্যাক্তির সন্তান ই হোক) তেমনি একজন সদগুরুর কাছে দীক্ষা পেতে হলে শিষ্যরও কিছু যোগ্যতা থাকা দরকার। সদশিষ্য না হলে সদগুরুর সান্নিধ্য পাওয়া যায় না।
বলা হয়ে থাকে যে, সদ্গুরু পাওয়া যত কঠিন সদশিষ্য পাওয়া তার চেয়েও বেশি কঠিন। একজন যথার্থ সদশিষ্যই পরবর্তীকালে সদগুরুর ভূমিকা পালন করে। তাই সত্যানুসন্ধানী শিষ্যের যােগ্যতা ও গুণ সম্বন্ধেও আমাদের অবহিত থাকতে হবে। সদশিষ্য কখনােই গুরুর সামনে নিজেকে বিজয় মনে করেন না। একটি গল্প বলছি, এক যুবক নিজেকে অনেক বিজ্ঞ মনে করতো । সে একদিন ভগবান সম্বন্ধে জানার জন্য একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক বা গুরুর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল । কিন্তু গুরুদেব যখন তার প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন তখন সে বলতে লাগল, 'আমি ওসব জানি।' শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত সে তর্ক শুরু করে দিল। তখন গুরুদেব তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি গ্লাসে জল ঢালতে লাগলেন। ঢালতে ঢালতে গ্লাসটি ভর্তি হয়ে জল উপচে পড়তে লাগল । যুবকটি তা দেখে গুরুকে বলল, “এ কী করছেন? জল তাে উপচে পড়ছে! জলঢালা বন্ধ করুন।" তখন গুরু বললেন, “হ্যা, তােমার ক্ষেত্রেও আমি একই ভুল করছি। অসংখ্য পূর্ব-ধারণায় তােমার মাথা ভর্তি হয়ে আছে। তাই শান্ত্রের কথা তােমার ভেতরে না। ঢুকে উপচে পড়ছে। " যুবক বুঝতে পারল তার সমস্যাটি কোথায়। সুতরাং, যারা মনে করে, তারা সব জানে, তারা কখনােই কোনােকিছু জানতে ও শিখতে পারে না। তাই শিষ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যােগ্যতাগুলাে হলাে : গুরুদেবের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস থাকতে হবে। শ্রবণের প্রতি আগ্রহী, বিনয়ী ও তত্ত্বজিজ্ঞাসু হতে হবে। গুরুদেবের সেবা ও আদেশ পালনে উন্মুখ হতে হবে।
পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি ভক্তিমান হতে হবে। শিষ্যের যােগ্যতা সম্বন্ধে শাস্ত্রের কথা : ভাগবতে (১১/৩/২১) বলা হয়েছে- তস্মাৎগুরুং প্রপদ্যেত জিজ্ঞাসু শ্রেয়মুত্তমম” অর্থাৎ শিষ্য হবেন জীবনের চরম ও চিরন্তন লক্ষ্যের বিষয়ে তত্ত্বজিজ্ঞাসু। জীবনের চিরস্থায়ী পরম কল্যাণ সাধনে শিষ্যকে হতে হবে অত্যন্ত অনুরাগী। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় (৮/৩৪) বলা হয়েছে- “তদ্বিদ্ধি প্রণিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া । উপদেক্ষ্যন্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্তত্ত্বদর্শিনঃ", অর্থাৎ সদ্গুরুর শরণাগত হয়ে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা করাে, বিনম্র চিত্তে তত্ত্ব জিজ্ঞেস করাে এবং অকৃত্রিম সেবার দ্বারা তাঁকে সন্তুষ্ট করাে, তাহলে তদ্রষ্টা পুরুষ তােমাকে জ্ঞান উপদেশ দান করবেন। আবার শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (৬.৩৮) বলা হয়েছে- “যস্য দেবে পরা ভক্তির্যথা দেবে তথা গুরৌ। তসৈতে কথিতা হ্যর্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ॥", অর্থাৎ যে মহাত্মাগনের গুরু ও ভগবানের প্রতি পরা ভক্তি রয়েছে, কেবল তাদের কাছেই বৈদিক জ্ঞানের সমস্ত তাৎপর্য স্বতঃই প্রকাশিত হয়।
সর্বপরি পারমার্থিক উন্নতি সাধন তথা জীবনের পরম প্রয়োজন লাভের জন্য একান্ত নিষ্টাবান হতে হবে। এবারে তো যোগ্যতা সম্পর্কে ধারনা হল, এবারে তাহলে দীক্ষার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানব। হরিনাম দীক্ষার পূর্বানুশীলন (ইসনকন থেকে) শ্রীগুরু চরণাশ্রয়ের মানপত্র ছয় মাস বা তার আগে থেকে সংগ্রহ করতে হবে। এক বছর বা তার বেশি থেকে চারটি নিয়ম যথা- অমিষ আহার (মাছ, মাংস,ডিম, রসুন, পিয়াজ, মসুর ডাল), নেশা (বিড়ি, পান, তামাক, চা, কফি, নর্শী), দ্যুত ক্রীড়া (তাস, পাশা, লটারী, জুয়া) এবং অবৈধ পুরুষ ও স্ত্রীসঙ্গ ইত্যাদি বর্জনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া। একবছর নিয়মিত ভাবে ১৬ মালা করে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ অভ্যাস করা । নিয়মিত ভাবে সূর্যোদয়ের পূর্বে স্নান বা শুদ্ধতা বজায় রাখা এবং পরে মঙ্গলআরতি করা বা তাতে যােগদান । ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ভােগ নিবেদন করে প্রসাদ সেবা করা (রান্নার ব্যক্তি যেন দীক্ষিত বা নিরামিষাশী হয়)।
বেদিতে রাখা পরম্পরা গুরুদের চিনতে ও তাদের নাম জানা। বিষ্ণু তিলক ধারণের স্থান ও বিষ্ণু নাম সমূহ জেনে, নিয়মিত তিলক ধারণ করা। কম পক্ষে সপ্তাহে একদিন আপনার নিকটবর্তী ইসকনের মন্দির বা ইসকন অনুমােদিত হরেকৃষ্ণ নামহট্ট সংঘে যােগদান করা এবং কিছু সেবা করতে সচেষ্ট হওয়া। শ্রীল প্রভুপাদের কয়েকটি গ্রন্থ অন্তত একবার পাঠ শেষ করতে হবে, যেমন ভগবদগীতা যথাযথ, ভাগবতম ১ম স্কন্ধ, মহাপ্রভুর জীবনী ও শিক্ষা, ভক্তিরসামৃত সিন্ধুর প্রথম ভাগ। এর সাথে আরো কয়েকটি গ্রন্থ জানা বিশেষ প্রয়োজন যেমন, শ্রীল প্রভুপাদ, একাদশি মাহাত্ম্য, উপদেশামৃত, নামহট্ট পরিচয়। বৈষ্ণব অপরাধ ও অগঠন মূলক উপহাস এড়িয়ে চলতে হবে। বৈষ্ণব মত বিরােধী কোন পেশা বা কার্যকলাপ (যেমন আমিষ ও মাদক জাতীয় দ্রব্যের বিক্রি ও মৎস্য মাংসের রান্না, চা, কফি তৈরি আর পরিবেশন এবং ডাক্তার হােলে ভ্রুন হত্যা ইত্যাদি) না করা।
ইসকন অনুমােদিত ভক্তদের প্রচার এবং ভাষণ শ্রবণে সংকল্প করা। নিয়মিতভাবে তুলসী বৃক্ষে জল দান, পরিক্রমা ও প্রণাম করা । একাদশী ব্রত পালন করা । নিয়মিত শ্রীগুরুদেবের চরণে পুষ্প দেওয়া । সংসার দাবানল, শ্রীগুরুচরণ পদ্ম, তুলসী ও গৌর-আরতি কীর্ত্তন গুলি জানা । মহাপ্রভু, শ্রীকৃষ্ণ, রাধারাণী, তুলসী ও বৈষ্ণবের প্রণাম মন্ত্র জানা। আরতি করার পদ্ধতি গুলি শিখা। যদি গৃহস্থ হনঃ-গৃহস্থ জীবনের নিয়ম কানুন জেনে, ব্যক্তিগত ভাবে সেগুলি মেনে চলা এবং কৃষ্ণভাবনা অনুসারে সন্তানাদি পালন করা । হরেকৃষ্ণ সকল ভক্ত মণ্ডলী কে আাবার ও প্রনাম,, একটা কথা বলার ছিল.! আপানাদের মতামতের গুরুত্বের উপর নির্ভর করেই আমার আগ্রহতা । আপনাদের উৎসাহই আমার লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। কোন পরামর্শ, উপদেশ,আদেশ বা কোন প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানাতে পারেন। আপনার মতামতের প্রত্যাশা রাখি। পরবর্তী পোস্টে আলোচনা করব, আত্মতত্ত্ব -বিজ্ঞান -শ্রীমদভগবদগীতার বিশেষত্ব কি পরবর্তী পোস্ট গুলো মিস করবেন না, নিয়মিত নজরে রাখুন আমার পোস্ট গুলোকে।
ভালো লিখেছেন।।
জয় গুরুদেব