উলুধ্বনি কেন দিতে হয়
উলুধ্বনিরঃ👉আমাদের হিন্দু সমাজে বাঙালীদের বারমাসে তেরো পূজা পার্বন। উৎসব-অনুষ্ঠান বাঙালীর সভ্যতা জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। সন্ধ্যাপূজা থেকে আরম্ভ করে যেকোনো পূজা পার্বণ তথা বিয়েবাড়ি সহ যেকোনো মাঙ্গলিক কর্মকান্ডে শঙ্খ, কাসর, ঘন্টা, ঢাক ইত্যাদির সাথে যেটা আমাদের কর্ণগোচর হয় তা হলো মহিলাদের সমবেত উলু ধ্বনি। এমনকি নজরুলের কবিতাতেও আমরা শুনি –“উলু দেয় পুরনারী”।
তবে এককালে বাঙালী হিন্দুদের অন্যতম সনাতন উপাচার এখনকার আধুনিক সমাজের কাছে অনেকটাই উপেক্ষিত। অনেক মেয়েরাই ঠিক মতো উলু দিতে পারেন না, বিব্রত বোধ করেন। বাঙালী সংস্কৃতির সাথে শিকড়ের যোগের কথা ভুলে গিয়েছি আমরা নিজেদের অজান্তেই। তাই চলুন আজকে আমরা উল্লেখ করবো মেয়েরা ঠিক কোন কারণে উলুধ্বনি দেয় এবং এর নানা উপকারিতার কথা।
উলুধ্বনির ছবি |
👉আসুন জেনে নেই উলু ধ্বনির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ:
ধ্বনিগত দিক দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উলু ধ্বনি হলো ওঁ কার ধ্বনি। ওঁ- যা পরমব্রহ্মের নিয়ত স্বরূপ বলে হিন্দুধর্মে মান্য করা হয়। অপরপক্ষে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের মত হলো, উ হলো রাধা এবং লু হলো কৃষ্ণ তাই উলু ধ্বনির দ্বারা আমরা এই দুই যুগলকেই স্মরণ করি।
উলুধ্বনি অ, উ এবং ম এই তিনটি বর্ণ নিয়ে গঠিত। এই তিনটি ধ্বনি আত্তীকরনের মাধ্যমে উচ্চারণের একটি সংহতি তৈরি করে যা মহাশূন্যে ব্রহ্মনাদকে কম্পিত করে। একপক্ষে বলা যায় এটি মহাচৈতন্য জাগরণ এর উদ্ধোক। ওঁ শব্দটি সংস্কৃত ‘অব’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন এবং ১৯টি অর্থযুক্ত। ব্যুৎপত্তি গত অর্থ ধরলে ওঁ হলো সকল শক্তির কারক, বাহক ও ধারক। সমগ্র ব্রম্ভান্ড ব্যাপী অজ্ঞান হরণকারী, সর্বজ্ঞ ও মঙ্গলময় উৎস। অ-কার আপ্তি বা আদিমতত্ত্ব বা সূচনার প্রতীক। উ- কার সমৃদ্ধি বা উৎকর্ষ বা অভেদত্ত্বের প্রতীক। ম- কার মিতি বা অপিতি শক্তির প্রতীক বলে মনে করা হয়ে থাকে। উলু ধ্বনির অ, উ এবং ম এই তিনটি ধ্বনি কিন্তু সৃষ্টি,স্থিতি ও লয়কেও বোঝায়।অনেকে বলেন যে এটার দ্বারা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে বোঝানো হয়।মান্ডুক্য উপনিষদেও এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
উলু ধ্বনিতে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তা কিন্তু আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কেবল একটি মাঙ্গলিক কাজের সূচনা করে তাই নয় একটা দৈব বাতাবরণ সৃষ্টি করে যার দ্বারা দেবতাদের আশীর্বাদ প্রাপ্তির একটি মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়। উলু ধ্বনির শব্দে শুভকাজের পবিত্রতা বহুগুণে বেড়ে এবং অশুভ শক্তি সেই জায়গায় আর না থাকতে পেরে বিতাড়িত হয় বলে মনে করা হয় কুমারিকা তন্ত্রে’ অষ্টম অধ্যায়ে স্পষ্ট বর্ণিত রয়েছে উলু ধ্বনি মেয়েরাই করতে পারেন। ছেলেরা উলুধ্বনি করলে তারা নির্বংশ হয়। এটি মূলত দেবীর উল্লাস বা হর্ষধ্বনি।সেই বিজয়গাথাকে স্মরণ করতেও উলু দেয়া হয়। যেহেতু এটি দেবী উপাচার তাই এটির উপরে মেয়েদের অধিকার স্বতঃসিদ্ধ।
👉কিভাবে মর্তলোকে উলুধ্বনির প্রচলন শুরু হলো এই প্রশ্নের উত্তর আমরা পাব নিচের তথ্য থেকে।
আসুন জেনে নেই উলুধ্বনির প্রচলনের প্রকৃত কারণঃ
আমরা জানতে পারি বৈষ্ণব শাস্ত্রমতে এক উপকথা থেকে,একটি ছোট্ট জঙ্গলের মধ্যে এক দরিদ্র ব্রাক্ষ্মন এবং তার কন্যা বসবাস করতেন।ব্রক্ষ্মন ছিলেন বিষ্ণু দেবের এক নিষ্ঠ ভক্ত। তিনি সরল মনে এবং নিষ্ঠার সঙ্গে শালগ্রাম শিলাকে পুজা করতেন। ছোটবেলা থেকে ব্রাক্ষ্মণ কন্যা পিতাকে বিষ্ণু দেবের পুজায় নিয়োজিত দেখে নিজেকেও তার চরনে সমর্পন করেন।
প্রত্যেকদিন পুজা করে পাপ্য সামন্য অর্থ মিলেই তাদের অন্ন সংস্থান হত এবং দিন চলত।এভাবে ব্রাক্ষ্মণ কন্যা ধীরেধীরে বালিকা থেকে যুবতীতে পরিনত হল।সে ক্রমে একেবারে অনন্যা হয়ে উঠল।একদিন এই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল এক রাক্ষস রাজা।এই কন্যাকে দেখে তার ভিষনভাবে পছন্দ হয়ে যায় এবং তাকে অপহরন করে নিয়ে যায় তার রাজ প্রসাদে।বলপূর্বক তাকে বিয়েও করে ফেলে।রাজা একটি শর্ত ছিল,রানী এখন রাক্ষস বংশীয় হওয়া সে কোন রকম দেবতার পুজা অর্চনা বা উপসনা করতে পারবে না।
এই শর্তের অধিনস্ত হয়ে রানী প্রত্যেকদিন নারায়ন শীলার সামনে অশ্রু বিসর্জন করত এবং তার ভাগ্যকে কটাক্ষ করত।এমন একদিন রাজা এসে বলল সে কিছু দিনের জন্য রাজ্য বাহিরে যাবে।এই সময় যেন রানী কোন রকম দেবতার উপসনা না করে।এই সুবর্ন সুযোগ দেখে রানী খুশি হল।রাজা চলে গেলে নারায়ন শীলাটিকে বাহিরে বের করে তাকে পুষ্প চন্দন দিয়ে সাজিয়ে পুজা করতে শুরু করল।চারিদিকে নারায়ন মন্ত্রের গুঞ্জন ধ্বনি হতে লাগল।এইভাবে কিছুদিন যেতে না যেতেই রাজা পুনরায় রাজ্য ফিরে এল এবং দেখল এখানে নারায়ন পুজা করছেন রানী।এই দৃশ্য দেখা মাত্র আদেশ দিলেন নারায়ন শীলাটিকে গঙ্গা বিসর্জন দিয়ে আসতে।রানী তখন বাধ্য হয়ে নারায়ন শীলাটিকে মাথায় নিয়ে গঙ্গার পথে রহনা দিলেন।যাওয়ার পথে মন স্থির করলেন তিনি নিজেকেও গঙ্গার বুকে বিসর্জন দেবেন এবং মনে মনে গঙ্গা মায়ের কাছে এই দুই বিসর্জনের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।
এইভাবে হাটতে হাটতে তিনি নদীর তীরে পৌছিয়ে প্রথমে হাটুজল,তারপর কোমরজল এবং অবশেষে একেবারে বুকজলে দাড়ালো।এই সময় তিনি হঠাৎ পিছনে থেকে শুনলেন একটি দৈব্যবানী ঘোষনা করা হচ্ছে।সেখানে বলা হয়েছে, কন্যা তুমি শীলাটি নিয়ে আবার পুনরায় তোমার গৃহে ফিরে যাও।আমাকে যদি একান্ত পুজা নিবেদন করতে হয় তাহলে কোন রকম মন্ত্র ছাড়াই শুধু মাত্র কয় একবার উলুধ্বনি করলেই আমি পুজা গ্রহন করব।
নারায়ন দেব আরো বললেন নারীজাতি শুধু মাত্র উলুধ্বনি মাধ্যমে পুজা অর্পন করতে পারবে।এই কথা শুনে ব্রাক্ষ্মণ কন্যা পুনরায় প্রসাদে ফিরে গেল এবং আজীবন উলুধ্বনির মাধ্যমে নারায়নের পুজা অর্চনা করল।অবশেষে তার মৃত্যুর পর নারায়ণে শীচরনে ঠাই পেল।
এরপর থেকে মর্তলোকে উলুধ্বনি প্রচলন হল। আর নারীদের মন্ত্র পরার কোন বাধ্য বাধকতা নেই। শুধুমাত্র উলুধ্বনির তে সকল দেবতা পুজা গ্রহন করে। আর এই কারনে পুরুষেরা উলুধ্বনি করে না। তারা সর্বকালে স্বাধীন এবং মন্ত্র মাধমে সকল দেবতাকে আহবান করে। আর মেয়েদের অসীম ক্ষমতা শুধুমাত্র উলুধ্বনির মাধমে মন্ত্র ছাড়াই সকল দেবতাকে সন্তুষ্টু করতে পারে। তবে ডিজিটাল মহিলা বা মেয়েরা উলুধ্বনি দিতে লজ্জা বা সংকোচ বোধ করে।
👉কখন কিভাবে কতবার উলুধ্বনি দেয়া হয়
গৃহপ্রবেশে ৫ ঝড় উলুধ্বনি দেওয়া হয়। পূজায় ৩ ঝড় উলুধ্বনি দেয়া হয়। ছেলে শিশুর জন্মের সময় ৯ ঝড়। মেয়ে শিশুর জন্মের সময় ৭ ঝড়। বিয়ের সময় ১৪ ঝড়। ভূমিকম্পের সময় ঘনঘন উলুধ্বনির চল রয়েছে।
♥হরে কৃষ্ণ♥
#tag;উলুধ্বনি দেবো কেন,উলুধ্বনি কেন দেওয়া হয়,মহিলারা কেন উলু দেয়?,মহিলারা কেন উলুধ্বনি দেয়,উলুধ্বনি কেন করা হয়?,মাঙ্গলিক কাজে কেন উলুধ্বনি দেয়া হয়,উলুধ্বনি অর্থ,শঙ্খ উলুধ্বনি,মহিলারা কেন উলু দেয়,মহিলারা কেন উলু দেয়,উলুধ্বনি,মহিলারা উলুধ্বনি দেন কিন্তু পুরুষরা উলুধ্বনি দেন না কেন,মেয়েরা কেন উলুধ্বনি দেয়,উলুধ্বনি কেন করা হয়,উলুধ্বনি মানে কি,উলুধ্বনি কেন দেওয়া হয় উলুধ্বনির মাহাত্ম্য,উলুধ্বনি কি,উলুধ্বনি মানে কি,উলুধ্বনি কেন করা হয়,উলুধ্বনি দেবো কেন,মাঙ্গলিক কাজে কেন উলুধ্বনি দেওয়া হয়,উলু ধ্বনি দেওয়া,শঙ্খ বাজা উলু ধ্বনি দাও,উলুধ্বনি কেন দিতে হয়
উলুধ্বনি কেন দেওয়া হয়
উলুধ্বনি
উলু দেওয়া
উলুধ্বনির ইতিহাস
উলুধ্বনি অর্থ
সঠিক তথ্য অনুযায়ী লেখার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।