সংস্কৃত ঘড়ি বা হিন্দু ধর্মের ঘড়ি

প্রাচীন ঘড়ির ইতিহাস 

ঘড়ি, ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ড, প্রহর শব্দগুলির সঙ্গে আজ আমরা সবাই পরিচিত।"সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়" কথাটিও বহুবার শুনেছি এবং বাস্তবে দেখেছি। মানুষের জীবনের সাথে সময় অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়  আর যে সময় নিয়ে এত কথা বলা হলো, সেই সময় মাপে কিন্তু ঘড়ি। অনেক বিবর্তনের পথ বেয়ে সময় আজ বাঁধা পড়েছে ঘড়ির কাঁটায়। আরো পড়ুন : বিদ্রোহভূমি বরেন্দ্রভূমির কৈবর্ত বিদ্রোহ সংস্কৃত "ঘটি" বা "ঘটিকা" শব্দের প্রাকৃত রূপ হচ্ছে "ঘড়ি।" "ঘড়ি" বা "ঘটিকা" শব্দের মৌলিক মানে "ক্ষুদ্র পাত্র।" এখনো গ্রামবাংলায় ঘটির ব‍্যবহার আছে। আর আছে "তালপুকুরে ঘটি ডোবে না"-র মতো প্রবাদ। আছে "বাঙাল-ঘটি" অম্লমধুর দ্বন্দ্ব। প্রাচীন ভারতে সময় মাপার বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। এর মধ্যে জলভরা ঘটি দিয়ে সময় মাপার মাপকাঠিটি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। আফগানিস্তানের কাবুলের কাছে কুষাণ সম্রাট হুবিষ্কের একখানি অভিলেখে (১২৯ খ্রি: ) সময়কাল অর্থে "ঘটিক" শব্দের উল্লেখ আছে।

ঋগ্বেদে "মুহূর্ত" শব্দের উল্লেখ আছে, যার মান ৪৮ মিনিট। ঋগ্বেদে দিন ও রাত্রিভেদে অহোরাত্রের দুটি বিভাগের উল্লেখ দেখা যায়। এর মধ্যে দিনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে---প্রাত: সবন, মাধ‍্যন্দিন সবন ও তৃতীয় সবন। আবার কখনও দিনকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে---প্রাত: বা উদয়, সঙ্গব, মাধ‍্যন্দিন বা মধ‍্যাহ্ন, অপরাহ্ন ও সায়ং বা সায়াহ্ন বা অস্তগমন। এর প্রতিটি ভাগে তিন মুহুর্ত অর্থাৎ দুই ঘণ্টা, চব্বিশ মিনিট কাল গণনা করা হতো। এ বিষয়ে ঋগ্বেদের ৬/৯/১০, ১০/৩৪/১১, ৩/৫৩/৮ মন্ত্রগুলি উল্লেখযোগ্য।


এরপর "শতপথ ব্রাহ্মণ" (১৩/৩/২)-এ দেখা যায়, সেখানে অহোরাত্রকে ৩০ মুহূর্তে এবং বছরকে ৩০ x ৩৬০= ১০, ৮০০ মুহূর্তে ভাগ করা হয়েছে। আবার "তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ" (৩/১০/১)-এ দিনের পঞ্চদশ মুহূর্তকে "চিত্র", "কেতু" ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তবে ভারতের সর্বত্র কাল নিরূপণ এক রকম ছিল না। এর মধ্যে মনুসংহিতার সঙ্গে অমরকোষের কিছুটা তফাৎ লক্ষ্য করা যায়। যেমন, মনুসংহিতায় (১/৪৬) আছে, ১৮ নিমেষ= এক কাষ্ঠা, ৩০ কাষ্ঠা মানে ১ কলা, ৩০ কলা মানে ১ মুহূর্ত এবং ৩০ মুহূর্ত মানে এক অহোরাত্র বা ২৪ ঘণ্টা। অন্যদিকে, অমরকোষে (৩/১১-১২) আছে, ১৮ নিমেষ মানে ১ কাষ্ঠা, ৩০ কাষ্ঠা মানে ১ কলা, ৩০ কলায় ১ ক্ষণ, ১২ ক্ষণে ১ মুহূর্ত (৪৮ মিনিট) এবং ৬০ মুহূর্তে ১ অহোরাত্র বা ২৪ ঘণ্টা। আবার কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে (২/২০) দেখা যায়, ২ ত্রুটিতে ১ লব, ২ লবে ১ নিমেষ, ৫ নিমেষে ১ কাষ্ঠা, ৩০ কাষ্ঠায় ১ কলা, ৪০ কলায় ১ নাডিকা বা ২৪ মিনিট, ২ নাডিকায় ১ মুহূর্ত এবং ১৫ মুহূর্তে এক দিন বা এক রাত্রি।


এই নাডিকার অপর নাম "নাড়ী", আর অর্ধ মুহূর্তের অপর নাম "ঘটি", " ঘটিকা" ও দণ্ড। এই কাল বিভাগ কাল্পনিক এবং ভারতীয় জ‍্যোতিষ শাস্ত্রের মতে, কাল বিভাগ হওয়া উচিত প্রাণ বা নি: শ্বাসের সাহায্যে। তাই "সূর্যসিদ্ধান্ত" অনুসারে, ৬ নি: শ্বাস বা প্রাণে (৪ সেকণ্ড) হয় ১ বিনাড়ী বা ২৪ সেকেণ্ড, ৬০ বিনাড়ীতে ১ নাড়ী (২৪ মিনিট) এবং ৬০ নাড়ীতে ১ অহোরাত্র বা ২৪ ঘণ্টা।"সূর্যসিদ্ধান্ত" গ্রন্থে (১৩/২০-২২) শঙ্কু, যষ্টি, ধনুক, চক্র ইত্যাদি ছায়া মাপার যন্ত্র এবং জলযন্ত্র কপাল যন্ত্র, ময়ূর মূর্তি, নরমূর্তি, বানর মূর্তি ও বালুকা যন্ত্রের সাহায্যে সময় মাপার কথা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে তলায় ছিদ্রযুক্ত একটি নির্দিষ্ট আকারের তামার পাত্র জলের ওপর বসালে অহোরাত্রের ৬০ ভাগের ১ ভাগ সময়ে সেটি জলপূর্ণ হয়ে ডুবে যেতো এবং এর নাম ছিল "কপাল যন্ত্র।" "কপাল" ও "ঘটি" দুটি সমার্থক শব্দ।


মোগল ঐতিহাসিক আবুল ফজল আল্লামীর লেখা "আইন-ই-আকবরী"-তে উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দু পণ্ডিতরা দিন ও রাতকে চার ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগের নাম দেন "প্রহর।" আর সময় মাপার জন্য একশো টাঙ্ক পরিমাণ তামা বা অন্য কোনো ধাতুর তৈরি একটি পাত্রের নিচে ফুটো করে তাতে ৫ আঙুল লম্বা এবং এক মাষা পরিমাণ সোনার তৈরি নল ঢোকাতে হয়। এরপর পাত্রটি জলে ডুবতে যতটা সময় নেয়, তা হচ্ছে এক ঘড়ি। আর তা কাঁসার তৈরি ঘণ্টায় আঘাত করে ঘোষণা করে দেওয়া হয়, সময় এক ঘণ্টা। যে ব‍্যক্তি ঘণ্টা বাজাতেন, তাঁর নাম ছিল "ঘড়িয়ালা" কিংবা "ঘড়িয়ালী।"

তাহলে দেখা যাচ্ছে, যে জলপূর্ণ ক্ষুদ্র পাত্রের সাহায্যে অহোরাত্রের ৬০ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ২৪ মিনিট কাল সময় মাপা হতো, তার নাম ছিল "ঘটি।" এরপর এই ২৪ মিনিট সময়ের নাম হয় "ঘটি" বা "ঘড়ি।" আরও পরে যে ঘণ্টা বাজিয়ে এক ঘড়ি অর্থাৎ ২৪ মিনিট সময় ঘোষণা করা হতো, তার নাম হয় "ঘড়ি।" পরবর্তীকালে এ থেকেই সময়মাপক যন্ত্রের নাম হয় "ঘড়ি।" এখনো ঘড়ি আমাদের প্রতিদিন সময় মেপে চলেছে।

সংস্কৃত ঘড়ি 

সংস্কৃত ঘড়ি
সংস্কৃত ঘড়ির ছবি

ঘড়ির সময় ‌  অধুনা কঃ সময়ঃ? (এখন সময় কত?) ১ঃ০০= একবাদনম্। ১ঃ১৫= সপাদ একবাদনম্। ১ঃ৩০= সার্ধ একবাদনম্। ১ঃ৪৫= পাদোন দ্বিবাদনম্। এই চারপ্রকার সময়ের ক্ষেত্রে এই নিয়ম।  অন্যান্য ক্ষেত্রে ১ঃ১০= দশ-অধিক-একবাদনম্। ১ঃ১১=একাদশাধিক-একবাদনম্। এভাবে চলতে থাকে পাদোন এর পূর্ব পর্যন্ত। পাদোনোর পর থেকে ঊন ব্যবহার করতে হবে।যেমনঃ ১ঃ৫০ = দশ-ঊন-দ্বিবাদনম্। ১ঃ৫৫= পঞ্চ-ঊন-দ্বিবাদনম্। এভাবে অন্যান্য সময়ের ক্ষেত্ররও হবে। ২- দ্বিবাদনম্ ৩-ত্রিবাদনম্ ৪-চতুর্বাদনম্ ৫-পঞ্চবাদনম্ ৬-ষডবাদনম্ ৭-সপ্তবাদনম্ ৮-অষ্টবাদনম্ ৯-নববাদনম্ ১০-দশবাদনম্ ১১-একাদশবাদনম্ ১২-দ্বাদশবাদনম্।

বৈদিক যুগের ঘড়ি

বৈদিক যুগের ঘড়ি

১. ঈশ্বর:- পরমবহ্ম I
২.পক্ষ :- শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ I
৩.অনাদি তত্ত্ব :-পরমাত্মা, জীবাত্মা, প্রকৃতি I
৪.বেদ :- ঋগ্বেদ, যদুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ I
৫.মহাভূত :- খীত, জল, পাবত, আকাশ, সমীরা I
৬.দর্শন :- সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, পূর্ব মীমাংসা, উত্তর মীমাংসা (ব্রহ্মসূত্র), বৈদেশিক I
৭.সপ্ত মহাপরাধ :- চুরি, ব্যভিচার, হত্যা/ ভ্রুননিধন, অগ্নিসংযোগ, নেশা, মদ্যপান, অসততা, অশ্লীলতা I
৮.যোগ :- যম, নিয়ম, আসন, প্রাণায়াম, প্রত্যাহার, ধারণা, ধ্যান, সমাধি I
৯.নবদ্দার :- দুই চক্ষু, দুই কর্ণ, দুই নাসারন্ধ্র, মুখ, পায়ু ও উপস্থ I
১০.দিশা :-  উর্ধ, ঈশান, পূর্ব, আগ্নেয়, দক্ষিণ, নৈঋত্য, পশ্চিম, বায়ব্য, উত্তর, অধাে I
১১. উপনিষদ :- ঈশ,ঐতবেয়, শেতাশ্বতর, কট, কেন, ছান্দোগ্য, প্রশ্ন, তৈতিতরীয়, বৃহদারণখ, মান্ডুক্ক, মন্ডক I
১২.আদিত্য :- দ্বাদশ আদিত্য I


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url