ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগ রহস্য
শ্রীকৃষ্ণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও দেহত্যাগ :
সাধারণত মানুষেরা মনে করে পায়ে তীর বিদ্ধ হওয়ার ফলে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয়েছিলো। এদের চিন্তার দীনতা দেখলে আমি অবাক হয়ে যাই। পায়ে তীর লাগলে কারো কি মৃত্যু হয় ? কারো তীরের আকস্মিক আঘাতে হয় নি মানবরূপী ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু, শ্রীকৃষ্ণেরই পরিকল্পনা ছিলো এটি, শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগ সম্পর্কে শ্রদ্ধেয় রাজ শেখর বসুর অনুবাদ করা মহাভারতে বলা আছে,অগ্রজ বলদেবের দেহত্যাগ দেখে কৃষ্ণ কিছুক্ষণ সেই বনে বিচরণের পর ভূমিতে উপবেশন করলেন এবং গান্ধারী ও দুর্বাসার শাপের বিষয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। xxxx
অনন্তর তাঁর প্রয়াণকাল আগত হয়েছে এই বিবেচনায় তিনি ইন্দ্রিয়গ্রাম সংযম এবং মহাযোগ আশ্রয় করে শয়ান হলেন। সেই সময় জরা নামে এক ব্যাধ মৃগ মনে করে তাঁর পদতলে শরবিদ্ধ করলো। তার পর সে নিকটে এসে যোগমগ্ন পীতাম্বর চতুর্ভূজ কৃষ্ণকে দেখে ভয়ে তার চরণে পতিত হলো। মহাত্মা কৃষ্ণ ব্যাধকে আশ্বাস দিলেন এবং নিজ কান্তি দ্বারা আকাশ ব্যাপ্ত করে উর্ধ্বে স্বকীয় লোকে প্রয়াণ করলেন। অনেকেই বিভিন্ন মহাভারতের রেফারেন্স দিয়ে বলে- অর্জুন, চিতায় জ্বালিয়ে শ্রীকৃষ্ণের দেহের সৎকার করেছে।যদিএ এটি আমার কাছে তেমন সত্য মনে হয় না, দ্বিতীয়ত এই কারণে যে- মহাভারতগুলো নানাভাবে বিকৃত ও প্রক্ষিপ্ত এবং প্রথমত এই কারণে যে- অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করা হয় মৃত ব্যক্তির পারলৌকিক উন্নতি বা মুক্তির জন্য। শ্রীকৃষ্ণ যেখানে নিজেই ঈশ্বর, সেখানে অন্য কেউ তার পারলৌকিক মুক্তির জন্য কোনো কিছু করবে কিভাবে ?
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হলো মৃত ব্যক্তির আত্মার সদগতির জন্য পরমপিতার কাছে প্রার্থনা।অর্জুন যদি শ্রীকৃষ্ণের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করেই থাকে, তাহলে শ্রীকৃষ্ণের উদ্ধারের জন্য অর্জুন কার কাছে প্রার্থনা করেছে ?
কৃষ্ণের দেহত্যাগ |
শ্রীকৃষ্ণের তথাকথিত অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পর্কে এসব অসঙ্গতি বিবেচনা করে আমার কাছে রাজশেখর বসুর মহাভারতে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগ সম্পর্কিত ঘটনার বর্ণনাই সত্য এবং বাস্তব বলে মনে হয়। যা হোক, কৃষ্ণের দেহত্যাগের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট দুজন ব্যক্তি- একজন গান্ধারী, অন্যজন দুর্বাসা মুনি। প্রথমে দুর্বাসা মুনি এবং পরে গান্ধারী প্রসঙ্গে বলছি- দুর্বাসা মুনির পিতার নাম মহর্ষি অত্রি, মাতার নাম অনসূয়া। দুর্বাসা মুনির স্ত্রীর নাম ছিলো কন্দলী। বিবাহের সময় দুর্বাসা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, স্ত্রীর একশত পর্যন্ত অপরাধ তিনি ক্ষমা করবেন। এই প্রতিজ্ঞা অনুসারে ১০১তম অপরাধের বেলায় শাপ দিয়ে তিনি স্ত্রীকে ভস্ম করে দেন। দুর্বাসা তার ক্রোধের জন্য যেমন ছিলো বিখ্যাত, তেমনি তার বাতিক ছিলো নানা উদ্ভট কর্মকাণ্ডের, এরকম একটি ঘটনা হলো-
গান্ধারীর অভিশাপ ও শ্রীকৃষ্ণ -
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর শত পুত্রের মৃত্যু শোক সইতে না পেরে গান্ধারী কৃষ্ণকে এই বলে অভিশাপ দেয় যে- কুরুবংশের মতো তার যদুবংশও ধ্বংস হবে। কৃষ্ণ গান্ধারীর এই শাপকে স্বীকার করে নেয় এবং সেই অনুযায়ী খুব অল্প সময়ের মধ্যে অন্তর্কলহে যদু বংশে অশান্তি ও বিপর্য়য় শুরু হয়ে যদু বংশ ধ্বংস হয় এবং কৃষ্ণের দ্বারকা নগরী সমুদ্রে বিলীন হয়। এরপর বলরাম ও কৃষ্ণ বনে চলে যান এবং কিছুদিন পরেই বলরাম দেহত্যাগ করলে শ্রী কৃষ্ণ নিজেও প্রাণ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। শ্রীকৃষ্ণ দেহত্যাগের জন্য মহাযোগ আশ্রয় করে শয়ন করলে দুর্বাসা মুনির শাপের সাথে সাথে গান্ধারীর সেই শাপের কথাও শ্রীকৃষ্ণের স্মরণে আসে। এক্ষেত্রে কারো কারো মনে হতে পারে, শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর হলেও এই দু্ইজনের শাপকে তিনি এড়াতে পারলেন না কেনো?অন্য সব ঘটনার সাথে এ দুটি ঘটনাও ছিল শ্রীকৃষ্ণেরই পরিকল্পনার ফসল, জরা যাতে শ্রীকৃষ্ণের পদতলকে তীর মেরে বিদ্ধ করতে পারে, সেজন্যই যেমন তিনি ইচ্ছা করেই তার পদতল ব্যতীত সারা শরীরে পায়েস লেপন করেছিলেন।ঠিক তেমনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শেষে হস্তিনাপুরে এসে যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসানোর ঠিক আগে,সভাসদরা সবাই মিলে যখন যুধিষ্ঠিরের মাথায় রা্জ মুকুট স্থাপন করার সম্মান দিচ্ছিলেন, রাজসভায় ঠিক সেই সময় , গান্ধারীর আগমনের জন্য শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষা করছিলেন, যাতে রুদ্রমূর্তি নিয়ে গান্ধারী আসে এবং শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দেয়; এর ফলে গান্ধারী অভিশাপ দেয় যে- শ্রীকৃষ্ণের যদু বংশ ধ্বংস হবে এবং যেকোনো
এক ব্যাধের তীর নিক্ষেপের ফলে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হবে।স্বয়ং শ্রী শ্রী কৃষ্ণ সেই অভিশাপকে স্বীকার করেন, ফলে গান্ধারী যেভাবে বলেছিলো- ঠিক সেভাবেই যদুবংশ ধ্বংস হয়, দ্বারকা নগরী সমুদ্রে নিমজ্জিত হয় এবং শ্রীকৃষ্ণের চরণে জরা নামক ব্যাধের তীর বিদ্ধ হয়। অন্য সকল ঘটনার মতো, এই দুটো ঘটনাও শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছাতেই ঘটেছিলো; সুতরাং শ্রীকৃষ্ণ- দুর্বাসা মুনি ও গান্ধারীর শাপকে এড়াতে পারেন নি, এটা আসলে একটা ভ্রান্ত বিশ্বাস; বরং দুর্বাসা মুনি ও গান্ধারী ঐ দুটো শাপের কথা উচ্চারণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্যই, শ্রীকৃষ্ণের ইচ্ছা অনুসারেই। জয় হিন্দ। জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীকৃষ্ণ। "ওঁ সহানা ভবতু" (ঈশ্বর আমাদেরকে রক্ষা করুন)
এই ওয়েবসাইটটিতে আরো জানতে পারবেন