ঘট স্থাপনের নিয়ম ও পূজোয় ঘট ব্যবহার করা হয় কেন?
পূজার ঘট স্থাপনঃ
মানুষের মধ্যে অনেকের মনে কৌতুহল হয় যে ,হিন্দু ধর্মের সাধারণত যেকোনো পুজোয় ঘটের ব্যবহার কেন করা হয়? কালিকা পুজা,দুর্গে দুর্গতিনাশিনী পূজা পুজা,হরি পূজা পুজা ,মহাদেব পুজা সহ প্রায় সকল ধরনের পুজায় দেখা যায় ঘট পূজা করতে।আপনি যে কোন পূজায় করুন না কেন বা যে প্রতিমা থাকুক আর না থাকুক ঘট থাকবেই হবে।
--হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের যে কোন পুজোর সময় ঘট স্থাপন করা বাধ্যবাধকতা মুলক । ঘট কিন্তু কোন দেবী বা দেবতার প্রতিমা নয়। ঘট হলো ভগবানের নিরাকার অবস্থার প্রতীক। হিন্দুরা পুজোর সময় যেমন ভগবানের সাকার স্বরূপ কে পুজো করে তেমনি নিরাকার স্বরূপকেও পুজো করেন। তাই ঘট স্থাপন প্রতি পুজোতে একান্ত আবশ্যক। ঘট স্থাপন ছাড়া পুজো অসম্পূর্ণ বলে মনে করা হয়। প্রায় সব পুজোয় ঘট লাগে।
যারা পুজোর কাজের সাথে জড়িত আমরা জানি ঘটের মধ্যে অনেক উপাদান ব্যবহার হয়। যেমন- পঞ্চশস্য, পঞ্ছগুড়ি,পঞ্চপল্লব,পঞ্চরত্ন, জল,মাটি,নারিকেল,গামছা,কান্ডকাঠি ইত্যাদি।
আজকে আমরা এসব উপাদানগুলোর তাৎপর্য সম্পর্কে জানব।
ঘট আমাদের দেহের প্রতিরুপ………
হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন পুজোর সময় পিঠ তৈরি করা হয় পঞ্চগুড়ি দিয়ে।
____পুজোর সময় পঞ্চমহাভুত-পঞ্ছগুড়ি_এর প্রতিক।পঞ্চবুড়ি ক্ষিতি , অপ , তেজ , মরুৎ , ব্যোম ইত্যাদি উপকরণ দিয়ে তৈরি হয়।
মৃত্তিকা দিয়ে পিঠ তৈরি করা হয় এই পঞ্চমহাভুত এর উপর।
*****মৃত্তিকা বেদীর উপর পঞ্চশস্য দেওয়া হয়।
____ পঞ্চশস্যকে আমাদের পঞ্চবৃত্তির প্রতীক হিসেবে মানা হয়।পঞ্চবৃত্তি হলো -কাম,ক্রোধ , লোভ, মোহ ও মাৎসর্স। এই 5 টি হল পঞ্চবৃত্তি ।
এর ওপর ঘট উপস্থাপন করা হয় ।
দেবীর ঘট/দেবতার ঘট |
যাদের বাড়িতে পুজো হয় তাদের দেহের প্রতিক হলো ঘট ।ধর্মের ভাষায় অথবা আধ্যাত্মিক ভাষায় দেহকে দেহঘটও বলা হয়ে থাকে।
*******ঘটের ভেতর পঞ্চরত্ন দেওয়া হয়।
____পঞ্চরত্নকে বলা হয় পঞ্চইন্দ্রিয়ের প্রতিক।পঞ্চরত্ন হলো চক্ষু, কর্ন, নাসিকা, ত্বক ও জিহ্বা ।
********এরপর জল ঢেলে পূর্ণ করা হয় ঘট ।
____ জল হল দেহরস বা রক্ত।
*******ঘটে এবার পঞ্চপল্লব দেওয়া হয়।
____ পঞ্চপল্লব হলো পঞ্চবায়ু এর প্রতীক।পঞ্চপল্লব পান, অপান, উদ্যান, সমান , ব্যান দিয়ে তৈরি করা হয় ।
******ডাব অথবা নারিকেল দেয়া হয় পঞ্চবায়ু বা পঞ্চপল্লব এর উপর ।আমরা জানি নারিকেল এ আমাদের মুখের মত চোখ, মুখ ,নাক দেখা যায়।
____সেই কারনে নারিকেল আমদের মুখমন্ডলের প্রতিরুপ।
--যেহেতু মস্তক থাকলে তাতে আচ্ছাদন দিতে হয়। তাই নারিকেল এর উপর গামছা বা বস্ত্র দেওয়া হয় মস্তক হিসেবে ।আর এটাই আমাদের দেহের প্রতিরুপ হিসেবে দেখা হয় ।
—আর কান্ডকাঠি হল চারবেদের প্রতীক।
ঘট স্থাপন করতে প্রয়োজন মাটি ( গঙ্গা মাটি হলে ভালো, অভাবে কোন পবিত্র পুষ্করিণী বা কোন নদীর মাটি), ধান , ঘট ( মাটি, পিতল, তামার ঘট প্রশস্ত – অভাবে স্টিলের ঘট ), জল, পল্লব ( আম্র পল্লব প্রশস্ত অভাবে অশ্বত্থ, বট, পাকুর ও যজ্ঞডুমুর পাঁচ বা সাতটি পাতা একত্রে ), গোটা ফল ( সশীষ কচি ডাব প্রশস্ত- অভাবে কাঁঠালী কলা, হরিতকী ) , পুস্পমালা, সিন্দুর ( ঘৃত সিন্দুর বা সরিষার তৈল ও সিন্দুর গোলা ), নতুন গামছা লাগে । মূর্তি তে পূজো করলে ঘট সম্পূর্ণ আচ্ছাদনের জন্য লাল শালু কাপড়, ৪ টে তিরকাঠি ও লাল ধাগা লাগে অন্যথায় প্রয়োজন নেই । প্রথমে নরম মাটি ভিজিয়ে মাটিতে দিন। ঘটে স্বস্তিক বা পুত্তলিকা সিঁদুর দিয়ে অঙ্কন করে ঘটে জল পূর্ণ করুন। ঘটের মুখে পল্লব দিন, পল্লবের প্রতিটি পাতায় সিঁদুরের ফোটা দিন। পল্লবের উপরে ফল বসান, ফলে পুত্তলিকা অথবা পাঁচটি সিঁদুরের ফোটা দিন। এবার গামছা দিয়ে ফল ঢেকে দিন। মালা দিন ঘটে । এবার ঘট সেই মাটির ওপর অল্প ধান দূর্বা দিয়ে তার ওপর দেবতার সামনে বসান। এবার মন্ত্র বলার পালা । সাধারণত ঋক, যজু, সাম বেদ মতে ঘট স্থাপন হয়। যেহেতু উত্তরপূর্ব ভারতে সাম বেদের মত বেশী- তাই এই পদ্ধতি অনুসরণ করুন।
মন্ত্র হল – ভূমিতে হাত দিয়ে বলুনঃ- ওঁ ভূমিরন্তরীক্ষং দ্যৌ র্দা ভূতায়াঃ । ধানে হাত দিয়ে বলুনঃ- ওঁ ধানাবন্তং করম্ভিণ- মপূপবন্তমুকথিনম্ । ইন্দ্র প্রাতর্জুযস্ব নঃ । জলে হাত দিয়ে বলুনঃ- ওঁ আ নো মিত্রাবরুণা ঘৃতৈর্গব্যৃতি মুক্ষতং । মধ্বা রজাংসি সুক্রুতু । পল্লব ধরে বলুনঃ- ওঁ অয়মুর্জাবতো বৃক্ষ উর্জীব ফলিনী ভব । পর্ণং বণস্পতে নুত্বা নুত্বা চ্ সূয়তাং রয়িঃ । ফল ধরে বলুনঃ- ওঁ ইন্দ্রং নরো নেমধিতা হবন্তে যৎ পার্য্যা যুনজতে ধিয়ন্তাঃ । শূরো নৃষাতা শ্রবসশ্চ কাম আগোমতি ব্রজে ভজা ত্বং নঃ । পুস্পমাল্য ধরে বলুনঃ- ওঁ পবমান বাশুহি রশ্মির্ভিবা জসাতমঃ । দধৎ স্ত্রোত্রে সুবীর্য্যাম ।। ইতি পুস্পেন । সিন্দুর ধরে বলুনঃ- ওঁ সিন্ধোরুচ্ছ্বাসে পতয়ন্তমুক্ষণং । হিরণ্যপাবাঃ পশুমপসু গৃভণতে ।। ঘট ধরে বলুনঃ- ওঁ ত্বাবতঃ পুরুবসো বয়মিন্দ্র প্রনেতঃ। স্মসি স্থাতর্হরীণাং ।। ওঁ স্থাং স্থীং স্থিরো ভব । হাত জোর করে দেবতার আহ্বানের জন্য বলুন ( পুরুষ দেবতা অর্থাৎ ভগবান)ঃ- ওঁ সর্বতীর্থোদ্ভবং বারি সর্বদেবসমন্বিতম্ । ইমং ঘটং সমারুহ্য দেবগণৈঃ সহ ।। ( মায়ের পূজোর ক্ষেত্রে )ঃ- ওঁ সর্বতীর্থোদ্ভবং বারি 'সর্বদেবসমন্বিতম্ । ইমং ঘটং সমারুহ্য দেবিগণৈঃ সহ ।।গায়ত্রী ঘটের ওপর ১১ বার জপ করুন যে দেবতার পূজা করছেন সেই দেবতার। চাইলে ১০৮ বার ও জপ করতে পারেন। ধরুন সরস্বতী দেবীর পূজা করছেন, তাহলে ঘটের ওপর মা সরস্বতীর গায়ত্রী জপ করবেন। ধরুন শিবের পূজো করছেন, তাহলে ঘটের ওপর শিব গায়ত্রী জপ করবেন । তারপর নিয়ম মতন ৫ মুদ্রা দ্বারা সেই দেবতার আহ্বান করতে হয়। সেটা অন্যদিন প্রকাশ করা হবে । পূজার সময় ঘট কোন কারনে পড়ে যাওয়া ঘোর অমঙ্গল। সেক্ষেত্রে ক্ষমা প্রার্থনা করে নতুন করে ঘট বসাতে হবে। আর পূজা শেষে ঘট বিসর্জন ( গৃহ লক্ষ্মী পূজায় গুরুবারে ঘট বসানো ব্যতিক্রম ) করবেন। আর যদি বিসর্জন না করেন, তাহলে সেই ভগবান বা সেই দেবী ঘটেই অবস্থান করবেন। প্রত্যহ নিয়মিত আপনাকে পূজা করতে হবে। তাই বেশীরভাগ ভক্ত পূজান্তে ঘট বিসর্জন করেন।আমাদের আরো জানতে হবে
আমরা জানি যে কোন পূজায় ঘট স্থাপন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।কারণ যেকোন পুজোর সময় ঘট আমাদের দেহের প্রতিরূপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই ওয়েবসাইটটিতে আরো জানতে পারবেন
#tag;
ঘট পূজা,
দেবতার জন্য ঘটঃ
ঘট স্থাপন,
কীর্তন ঘট পূজা,
লক্ষী পূজার ঘট বসানোর নিয়ম,
ঘট,
পূজাতে ঘট বসানোর রহস্য কি,
পূজোর সামনে কেন ঘট পাতা হয়,
পুজার ঘট স্থাপনের সহজ নিয়ম,
পূজাতে ঘট বাসানোর রহস্য কি,
পূজাতে হিন্দুরা কেন ঘট বসায়,
পূজায় ঘট স্থাপন করার নিয়ম
ঘট সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ভেঙে গেল।ধন্যবাদ।। 🙏