ভক্তি কি ও ভক্তি জীবনে বিঘ্ন ঘটার কারণ
যে কর্ম দ্বারা ঈশ্বরের প্রতি এবং মনে ঐকান্তিক প্রেম জন্মায় এবং সৃষ্টিকর্তা সব জায়গায় বিরাজমান( ঈশ্বর ‘সর্ব ভূতময়’) এই জ্ঞানের উদয় হয়ে সকল জীবের প্রতি দয়া স্নেহ ও ভালবাসা জন্মায় তাকেই ভক্তি বলা হয় অর্থাৎ তাই ভক্তি।
গুরু ভক্তি অভিলাষে ,থাকবি তক্তে বসে
নাম ধরে ডাকবি ওরে ভোলামন,
যা বলি তাই শোন,মনের মানুষ মিলবে তোর .......
-
ভগবান সর্বশক্তিমান, অন্তর্যামী, বিচারকর্তা, এই জ্ঞান উদয় হওয়াতে ভগবানের প্রতি ভয় জন্মায়, ভয় হতে ভগবানে বিশ্বাস আসে। এই বিশ্বাস ক্রমে ক্রমে অটল বিশ্বাসে পূর্ণ হলে, তখন-ই আসে ভগবানে পূর্ণ ভক্তি। এই ভক্তি ক্রমে ক্রমে অচলা ভক্তিতে পরিণত হলে তাকে বলে প্রেম। যখন ভক্তের মনে প্রেমের সঞ্চার হয় তখন ভগবানকে কাছে পাওয়ার জন্য ভক্তের মন উদগ্রীব হয়ে উঠে। ভক্তির অপর নাম ভালোবাসা।
ভক্তির ছবি |
ভালোবাসা, ভক্তি, স্নেহ, প্রেম বস্তুত একই, স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন নামে অভিহিত হয়ে থাকে। পরমেশ্বর ভগবানকে সাকার ভাবে শ্রদ্ধার সাথে তার সেবা পূজা অচর্না এবং ভগবানের নাম, গুণগান, শ্রবণ কীর্ত্তন, করার নাম-ই ভক্তি মার্গ বা ভক্তি যোগ। যারা ঈশ্বরকে সাকার রূপ ভেবে তার সেবা পূজা ও ভক্তি নিবেদন করে তাদের কে বলা হয় ভক্ত।
-
ভক্তির সংস্কৃত উচ্চারণ -भक्ति,যার আক্ষরিক অর্থ "সংসক্তি, অংশগ্রহণ, অনুরাগ, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, প্রেম, ভক্তি, উপাসনা, পবিত্রতা প্রভৃতি হতে পারে।ভক্তি সর্বপ্রথম হিন্দুধর্মে ব্যবহৃত হয়েছিল।যার প্রমান আমরা বহু গ্রন্থ উপ গ্রন্থ থেকে পেয়ে থাকি। একজন ভক্তের দ্বারা একজন ব্যক্তিগত দেবতা বা প্রতিনিধিত্বমূলক ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও ভালোবাসার কথা উল্লেখ করে ভক্তি। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের মতো প্রাচীন গ্রন্থে, এই শব্দের সহজ অর্থ হল অংশগ্রহণ এবং যেকোনো প্রচেষ্টার প্রতি ভালবাসা। যদিও ভগবদ্গীতায়, এটি ভক্তি মার্গের মতো আধ্যাত্মিকতার এবং মোক্ষের সম্ভাব্য পথগুলির একটিকে বোঝায়।
ভারতীয় ধর্মে ভক্তি হল "আবেগিক ভক্তিবাদ", বিশেষ করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি কারি ঈশ্বর বা আধ্যাত্মিক ধারণার প্রতি। এইভাবে,ভক্তির জন্য ভক্ত এবং দেবতার মধ্যে সম্পর্ক প্রয়োজন। অনেক সময় শব্দটি একটি পরম পূজনীয় সৃষ্টিকর্তাকে ভালোবাসার আন্দোলনকেও নির্দেশ করে, যা আলভার এবং নয়নারদের দ্বারা সূচনা ঘটে ছিল। যেটি ১ম সহস্রাব্দ সিই-এর দ্বিতীয়ার্ধে দেবতা বিষ্ণু (বৈষ্ণবাদ), ব্রহ্মা (ব্রাহ্মণ্যবাদ), শিব (শৈবধর্ম) এবং দেবী (শাক্তবাদ) এর মাধ্যমে গড়ে উঠেছিল ভক্তি ।
-
উদাহরণস্বরূপ, ভাগবত পুরাণ হিন্দুধর্মের ভক্তি আন্দোলনের সাথে যুক্ত একটি কৃষ্ণ-সম্পর্কিত পাঠ্য। ভক্তি শব্দটি ভারতে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মেও পাওয়া যায়, ভক্তি আধুনিক যুগেও খ্রিস্টধর্ম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে মিথস্ক্রিয়াকে প্রভাবিত করেছে এবং করছে। নির্গুণ ভক্তি (গুণবিহীন ঐশ্বরিক ভক্তি) শিখ ধর্মের পাশাপাশি হিন্দু ধর্মেও পাওয়া যায়। ভারতের বাইরে, কিছু দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় এবং পূর্ব এশীয় বৌদ্ধ ঐতিহ্যে সংবেদনশীল ভক্তি পাওয়া যায় এবং এটিকে কখনও কখনও ভাট্টি নামেও উল্লেখ করা হয়।
-
প্রাচীন ইতিহাস এবং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাওয়া যায় ভক্তি সাধারণত প্রকার হয়ে থাকে। যথা ঃজ্ঞান,প্রেম বা প্রেমা,বিজ্ঞান, শ্রদ্ধা, অহৈতুকী,ঊর্জিতা এবং মধুরা।ভক্তি কত প্রকার এর উত্তর পেতে হলে ভক্ত কয় প্রকার সেটা আগে জানতে হবে। মানুষ দুই ধরনের —ঈশ্বরে বিশ্বাসী ও ঈশ্বরে অবিশ্বাসী।ঈশ্বরে বিশ্বাসী মানুষ মানসিকতার দিক থেকে চার ধরনের — তামসিক, রাজসিক, সাত্ত্বিক ও শুদ্ধ সাত্ত্বিক। আবার পথের দিক থেকে মানুষ চারপ্রকার — জ্ঞানী,যোগী,কর্মী ও ভক্ত।ঈশ্বরকে জানার উদ্দেশ্যের দিক থেকেও মানুষ চার প্রকার —আর্ত, অর্থাথী, জিজ্ঞাসু ও জ্ঞানী। সব ধরনের মানুষকে ব্যাপকভাবে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। সকাম ভক্ত ও নিস্কাম ভক্ত। অতএব ভক্তি ও দুই প্রকার — বৈধী ভক্তি ও রাগানুগা বা প্রেম ভক্তি। শাস্ত্রীয় বিধি মেনে যাঁরা ঈশ্বরের উপাসনা করেন তাঁরা প্রথম শ্রেণীর । আর শুধু বিশুদ্ধ ভালোবাসার জন্যই যাঁরা ঈশ্বরকে প্রেমাস্পদ মেনে সাধনা করেন,তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণীর। এই দ্বিতীয় শ্রেণীর ভক্ত ই সর্ব শ্রেষ্ঠ। খৃষ্টান ধর্মে এঁদের মিষ্টিক,ইসলাম ধর্মে সুফি ও সনাতন ধর্মে এঁদের প্রেমিক ভক্ত বা মধুর ভাবের সাধক ইত্যাদি বলা হয়ে থাকে। ভক্তি দুই প্রকার যথা- ১ হৈতুকি ভক্তি ২ অহৈতুকি ভক্তি
হৈতুকি ভক্তি :- হৈতুকি ভক্তি হলো যে ভগবান আমি সুখ চাই আমাকে সুখ দাও। ভগবান আমি টাকা চাই আমাকে টাকা দাও।ভগবান আমি সন্তান চাই আমাকে সন্তান দাও ইত্যাদি পাওয়ার জন্য ভগবান কে ভালোবাসা বা ভগবান কে আরাধনা করা।
অহৈতুকি ভক্তি:- অহৈতুকি ভক্তি হলো হে ভগবান আমি কিছুই চাই না, তোমার যেমনটি ইচ্ছা তেমনটি করে আমাকে চালাও।তোমার যেমনটি ইচ্ছা হলে সুখ পাও তেমনটি করে আমাকে রাখো। হে ভগবান সবকিছুতে তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। শ্রীনারদ পঞ্চরাত্রে বলা হয়েছে- সর্বোপাধিবিনির্মুক্তং তৎপরত্বেন নির্মলম হৃষীকেশ হৃষীকেশসেবনং ভক্তিরুচ্যতে।। "সর্ব উপাধিমুক্ত অর্থাৎ কৃষ্ণসুখকামনা ব্যতীত ইহজীবনের ও পরজীবনের সমস্ত প্রকার আত্মেন্দ্রিয় সুঝ কামনা বর্জন করে, কেবল শ্রীকৃষ্ণপ্রীতির জন্যে ইন্দ্রিয়সমূহ দিয়ে ইন্দ্রিয়ের নিয়ামক শ্রীকৃষ্ণের সেবা করাকেই ভক্তি বলা হয়। " শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণনা আছে যে, পরম ভক্ত শ্রীউদ্ধব যখন ভগবদ্ভক্তি সম্বন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কে জিজ্ঞাসা করেন তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই কথা বলেছিলেন - আদরঃ পরিচর্যায়াং সর্বাজ্ঞৈরভিবন্দনম। মদ্ভক্তপূজাভ্যধিকা সর্বভূতেষু মন্মতিঃ। মদর্থেষজ্ঞচেষ্টা চ বচসা মদগুণেরণম। ময্যর্পণঞ্চ মনসঃ সর্বকামবিবর্জনম। অর্থাৎ,
১/ আদরের সজ্ঞে আমার পরিচর্যা করা,
২/সর্বাজ্ঞের দ্বারা আমার অভিনন্দন করা,
৩/ বিশেষভাবে আমার ভক্তের পূজা করা
৪/ সমস্ত জীবকে আমার সংঙ্গে সম্পকিত বলে মনে করা,
৫/ দেহের সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে আমার সেবা করা,
৬/ বাক্যের দ্বারা আমার মহিমা কীর্তন করা
৭/ মনকে আমাতে অর্পন করা এবং
৮/ সব ধরনের জড় ভোগবাসনা ত্যাগ করা।
এইগুলো ভগবদ্ভক্তের লক্ষন।
১) কারো প্রতি উদ্বেগের কারণ হওয়া
২) কারো দোষ বিচার করা
৩) অনুমোদিত শাস্ত্র সিদ্ধান্ত,আদেশ-নির্দেশ অবহেলা করা
৪) ভক্তির অনুকুলে বিধি-নিষেধ পালনে অবজ্ঞা করা
৫) ভগবদ্ সেবাকে অবজ্ঞা করা
৬) অপরাধ করা নামের প্রতি এটি মুলতঃ ১০ প্রকারের অপরাধ হয়ে থাকে।
৭) অপরাধ করা ধামের প্রতি এটি মুলতঃ ১০ প্রকারের অপরাধ হয়ে থাকে।
৮) বাহির থেকে(বাহ্যিক ভাবে) ভক্তের ভক্তির স্তর বিচার করা --উপদেশামৃত/ শ্লোকনং- ৬ এ বিদ্যমান।
৯) ইন্দ্রিয়ের অসংযমতা
১০) জড় বিষয়ে অত্যন্ত আসক্ত হওয়া
১১) ভগবদ্ভক্তের শ্রীচরণে অপরাধ করা
কটাক্ষ করা
সমালোচনা করা
শ্রদ্ধানা করা
ঘৃণা করা
১২) গুরুদেবের শ্রীপাদপদ্মে গুরুতর অপরাধ করা
গুরুদেবের আদেশ পালন না করা
গুরুদেবকে মনুষ্য শরীরে বিচার করা
গুরুদেবকে প্রণাম না করা
গুরুদেবের নিন্দা করা
গুরুদেবের সমালোচনা করা
গুরুদেবেরব উপর গুরুগিরি করা
গুরুদেবকে আদেশ-উপদেশ দেওয়া
গুরুদেবের সম্পদ ভোগ করা
গুরুদেবকে পরিত্যাগ করা
~ ভক্তিবিনোদ ঠাকুর রচিত শ্রী চৈতন্য শিক্ষামৃত।
(হরিবোল)