রাধা কৃষ্ণের আধ্যাত্মিক প্রেমের সম্পর্ক
শ্রীমতী রাধারানী ও শ্রী কৃষ্ণের মধ্যে কোন তফাৎ কি নেই আসলে তাঁরা এক। কেবল লীলা রস আস্বাদন করার জন্য দুই দেহ ধারন করেছেন (চৈঃচঃ আদি ৪/৯৮)।অনেকে প্রশ্ন করেন শ্রীকৃষ্ণ রাধারানীকে কোন অংশ থেকে সৃষ্টি করেছেন? ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে উল্লেখ আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে আনন্দ প্রদান করার জন্য তাঁর বাম অংশ থেকে শ্রীরাধাকে সৃষ্টি করেছেন।
![]() |
রাধাকৃষ্ণ/সনাতনী আলাপন |
বৃহৎ গৌতমীয় তন্ত্রে বলা হয়েছে - - - -
সত্ত্বং তত্ত্বং পরত্বং চ তত্ত্বত্রয়ং অহং কিল।
ত্রিতত্ত্বরূপিনী সাপি রাধিকা নম বল্লভা।।
“আমি যদিও নিত্যানন্দময়, তবুও আমি ত্রিতত্ত্বসরূপ, এই সৃষ্টির কার্য ও কারণ উভয়ই এবং উভয়ের অতীত। তেমনই, যদিও রাধা নিত্যানন্দময়, দিব্যানন্দের মূর্ত বিগ্রহ, তবুও তিনি ত্রিতত্ত্বস্বরূপা, সৃষ্টির কার্য ও কারণ এবং উভয়ের অতীত”। এর অর্থ হচ্ছে, ঠিক যেমন কৃষ্ণ সর্ব কারণের কারণ এবং সব কিছুর অতীত, তেমনি রাধা পরা শক্তি হওয়া সত্ত্বেও সর্ব কারণের কারণ ও সব কিছুর অতীত এবং তা সত্ত্বেও শ্রীকৃষ্ণের স্বরূপ অবিকৃত, একই - তিনি সর্ব কারণের কারণ।
শ্রীকৃষ্ণের অন্তরঙ্গা শক্তির সন্ধিনী অংশের দ্বারা শ্রীকৃষ্ণের সর্বাকর্ষক চিন্ময় কলেবর প্রকাশিত হয় এবং সেই অন্তরঙ্গা শক্তির হ্লাদিনী শক্তি সর্বাকর্ষক শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণকারী শ্রীমতী রাধারানীকে প্রকাশ করে। স্বরূপত রাধারানী হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী বা আনন্দদায়িনী শক্তি, যিনি নিত্যকাল শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত।
হ্লাদিনী শক্তির সার ‘ভগবৎ প্রেম’, ভগবৎ প্রেমের সার ‘ভাব’ এবং ভাবের পরম প্রকাশ হচ্ছে ‘মহাভাব’। শ্রীমতি রাধারানী হচ্ছেন মহাভাবের মূর্ত প্রকাশ এবং তাই শ্রীকৃষ্ণের আনন্দের একমাত্র উৎস।
শ্রীমতি রাধারানী কি শক্তি তিনি হলেন আদি শক্তি। তিনি তাঁর চিৎশক্তির বলে অসংখ্য গোপী ও লক্ষীদেবীদের কৃষ্ণের প্রীতি বিধানের জন্য সৃষ্টি করেছেন।শ্রীকৃষ্ণ ও রাধা রানী থেকে কি বিস্তার হয়?
অবতারী শ্রীকৃষ্ণ থেকে যেভাবে সমস্ত অবতারদের বিস্তার হয়, তেমনি শ্রীমতী রাধারানী থেকে সমস্ত লক্ষী, মহিষী ও ব্রজগোপিরা প্রকাশিত হন ( চৈঃচঃ আদি ৪/৭)।
শ্রীকৃষ্ণ সমস্ত জগতকে মোহিত করেন, কিন্তু শ্রীরাধা জগৎ মোহন শ্রীকৃষ্ণকেও মোহিত করেন। তাই তিনি সমস্ত দেবীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠা।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানীর সমস্ত লীলা হচ্ছে প্রেমময়। এ জগতে প্রেমের লেশমাত্র গন্ধ নেই। এটি কামময় জগত। কাম ও প্রেমের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। নিজের ইন্দ্রিয় তৃপ্তির বাসনা হলো কাম, আর পরমেশ্বর ভগবানের ইন্দ্রিয়ের প্রীতি সাধনের ইচ্ছাকে বলে প্রেম।
আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি বান্ছা হলো কাম
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।
রাধা - কৃষ্ণের প্রণয় ভগবানের হ্লাদিনী শক্তির বিকার। শ্রীমতী রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণ একাত্মা হলেও তাঁরা অনাদিকাল থেকে গোলোকে পৃথক পৃথক দেহ ধারন করে আছেন। এভাবে তাঁরা পরস্পরের প্রেমরস আস্বাদন করেন।
ঋক-পরিশিষ্টে উল্লেখ আছে - - - -
রাধয়া মাধবো দেবো মাধবো নৈব রাধিকা বিভ্রাজন্মে জনেস্বেতি-----”রাধা মাধবের দ্বারা বিভাসিত এবং মাধব রাধা দ্বারা বিভাসিত হয়েছেন। এভাবে পরস্পর দ্যুতিমান হয়ে তাঁরা লোকমধ্যে বিরাজ করছেন “।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরানে রাধারানীকে ‘ব্রহ্মান্ড জননী ‘ বলা হয়েছে। পদ্মপুরানে স্বয়ং শিবের উক্তি - - - - - -
“কৃষ্ণ জগতাং তাতঃ
জগন্মাতা চ রাধিকা “।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রথম পুরুষাবতার মহাবিষ্নু হতে জগত সৃষ্টি, আর সেই বিরাট পুরুষ মহাবিষ্নু শ্রী রাধা হতে উদ্ভব বলে শ্রী রাধাকে জগন্মাতা বলা হয়।
দেবাদিদেব শিব দেবর্ষি নারদকে বলেছেন - - - - প্রথমেই ‘রাধা’ শব্দ এবং পরে ‘কৃষ্ণ’শব্দ উচ্চারণ করতে। এর বিপরীত হলে ব্রহ্ম হত্যার পাপ হবে”।(শ্রী নারদ পন্চরাত্র ৫/৬/৬)।
ছান্দোগ্য উপনিষদে (৮/১৩/১) বলা হয়েছে - - - -
শ্যামাচ্ছবলং প্রপদ্যে শবলাচ্ছ্যামং প্রপদ্যে।
“শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভের জন্য আমি তাঁর শক্তির (শ্রীমতী রাধারানীর ) শরণাগত হই এবং তাঁর (শ্রীমতী রাধারানীর ) কৃপা লাভের জন্য আমি শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হই। “
শ্রীমতি রাধারানী ও শ্রীকৃষ্ণ, এই দুই তত্ত্বের রহস্য হৃদয়ঙ্গম করতে হলে গভীর পারমার্থিক উপলব্ধির প্রয়োজন। এক পূর্ণতত্ত্ব ভগবান দুইরূপে আনন্দ উপভোগ করছেন। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন শক্তিমানতত্ত্ব, আর শ্রীমতি রাধারানী হচ্ছেন অন্তরঙ্গা শক্তিতত্ত্ব। বেদান্ত দর্শন অনুসারে শক্তি ও শক্তিমানের মধ্যে কোন ভেদ নেই, তাঁরা অভিন্ন। মহাভাগবত ভক্তের কৃপা ব্যতিত কখনো এই গূঢ়তত্ত্ব হৃদয়ঙ্গম করা যায় না।
জয় রাধে, জয় কৃষ্ণ, জয় বৃন্দাবন।
দারুণ লাগলো।